মেট্রোতে উঠতে ভালোই লাগে রুশার। ওপর থেকে কী অদ্ভুত দেখায় ঢাকা শহরটা। দুপাশে সারি সারি দালান, আর মাঝখান দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন—ব্যাপারটা প্রতিবারই উপভোগ করে ও। একটার পর একটা স্টেশনে থামে ট্রেন, ব্যস্ত মানুষগুলো নেমে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায় একেক দিকে। রুশার কাছে মনে হয়, প্রতিটা মানুষই একেকটা ট্রেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ স্টেশনে ফিরে যায়। শুধু ওরই কোনো স্টেশন নেই।
রুশার ঠিক সামনে বস লোকটা হাঁ করে ঘুমাচ্ছে। মেট্রোতে উঠেই ঘুম দেয় কেউ কেউ। নির্ধারিত স্টেশনে এসে আবার ঠিক উঠে পড়ে ঘুম থেকে। রুশার মনে হয়, এই লোকগুলোর ভেতরে একটা বিল্টইন অ্যালার্ম সিস্টেম আছে। ট্রেনে উঠলেই অ্যাকটিভ হয়ে যায় সেই সিস্টেম। স্টেশনে এলেই অ্যালার্ম বলে, ‘এই ওঠো। এখন নামতে হবে।’ জেগে থাকা অধিকাংশ যাত্রীর চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে। কেউ কেউ কথা বলছে ফোনে। বাসে-ট্রেনে লোকজন এত জোরে কথা বলে যে আশপাশের সবাই শুনতে পায়। কেউ এভাবে জোরে কথা বললে রুশার ইচ্ছে করে জবাব দিতে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কানে ধরল সে। ভাবটা এমন যেন জরুরি কল এসেছে। উল্টো পাশের সিটে বসে জোরে জোরে কথা বলছে মাঝবয়সী এক লোক। তাকেই টার্গেট করল রুশা। লোকটা বলল, ‘স্যাম্পল পাঠাস নাই?’
‘না রে, পড়াশোনার এত চাপ, পাঠানোর সময় পেলাম কই?’ বলল রুশা।
‘আজকে কত তারিখ? এক সপ্তাহের মধ্যে স্যাম্পল পাঠানোর কথা। ক্লায়েন্ট কি বসে থাকবে?’ লোকটা রেগে গেল।
‘বসে থাকবে কেন? সারা দিন বসে থাকলে তো ওজন বেড়ে যাবে। তুই এক কাজ কর, ওকে একটু হাঁটিয়ে আন বাইরে থেকে।’ রুশার জবাবে লোকটা চোখ কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। বোঝার চেষ্টা করল মেয়েটা তার কথার পিঠে কথা বলছে কি না। রুশাও টের পেল ব্যাপারটা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি পরে কথা বলছি।’ ফোন রেখে দিল লোকটা। কড়া চোখে তাকিয়ে রইল রুশার দিকে। কিন্তু কথা চালিয়েই গেল রুশা। এখন থামলে লোকটার সন্দেহ আরও বাড়বে।
‘হ্যাঁ, পার্সিয়ান বিড়ালগুলো একটা বেকুব টাইপই হয়। কিছু বললেও নড়াচড়া করে না। শুধু তাকিয়ে থাকে।’
একটু অবাক হলো রুশা। নানু চোখে খুব ভালো দেখেন না। তারপরও হাঁটুর দিকে ঠিকই নজর গেছে তার। মা-বাবা হলে জীবনেও দেখতে পেত না। রুশা হেসে বলল, ‘কিছু হয়নি নানু। হাঁটুর জোর কত, পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম।’
ঝট করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলল রুশার দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটা। হাসি পেল রুশার।
‘আচ্ছা, এখন রাখি। আমার স্টেশন চলে এসেছে।’ বলে কান থেকে ফোন সরাল রুশা। অভ্যাসবশত লক খুলতেই দেখল ১৩টি মিসড কল। পাত্তা দিল না সে। অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে থেমে গেল ট্রেন। স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলতেই দ্রুত নেমে গেল রুশা।
মেট্রোস্টেশন থেকে বেরিয়ে রিকশা নিল সে। মিনিট বিশেক পর চলে এল তার চিরচেনা গলিতে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত ঢুকে গেল খয়েরি দরজার বাড়িটায়। পুরোনো একটা লিফটে চড়ে সোজা উঠে এল ৫ তলায়। বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপল রুশা। ‘কে?’ ভেতর থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ। জবাব দিল না রুশা। কলিংবেল চাপল আবার। ‘আরে কে?’ বলে দরজা খুলেই চমকে উঠলেন রুশার নানু। ততক্ষণে নানুকে জড়িয়ে ধরেছে রুশা। ‘ওমা একি! আরে আগে ভেতরে তো আসবি!’
কয়েক সেকেন্ড নানুকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে রইল রুশা। নানুর মেহেদি দেওয়া লাল চুলগুলো থেকে নারকেল তেলের গন্ধ আসছে। এই গন্ধটা রুশার ভালো লাগে। বড় করে শ্বাস নিয়ে নানুকে জড়িয়ে ধরেই ভেতরে ঢুকল সে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল মাটিতে। স্কুলের জুতা খুলে দ্রুত ডাইনিংয়ে গিয়ে চেয়ারে পা তুলে বসে রুশা বলল, ‘খাবার কী আছে, দাও তো নানু।’
পাশে এসে রুশার মাথায় হাত বুলিয়ে নানু বললেন, ‘তরমুজ খাবি?’
‘না।’
‘হালুয়া আছে সুজির। খাবি?’
‘না।’
‘তাহলে কী খাবি বাবা?’
‘খিচুড়ি খাব।’
‘আচ্ছা। খিচুড়ি করতে সময় লাগবে। ততক্ষণে তরমুজ খা?’
‘দাও।’
ফ্রিজ থেকে আধখানা তরমুজ বের করে আনলেন নানু। টেবিলে রেখে ছুরি দিয়ে কাটতে কাটতে বললেন,
‘তোর বাবা কতবার ফোন করেছে জানিস? বারবার জিজ্ঞেস করছিল, তুই এখানে এসেছিস কিনা।’
নানুর কথার কোনো জবাব দিল না রুশা। আঙুল দিয়ে টেবিল ক্লথ খুঁটতে লাগল চুপচাপ। নানু আবার বললেন,
‘এ রকম করিস কেন? তোর বাবা-মা তোকে নিয়ে কত টেনশন করে। তুই বুঝিস না?’
কাঁটাচামচ নিয়ে বাটি থেকে তরমুজের টুকরো তুলে খেতে শুরু করল রুশা। ‘পানসা তরমুজ। কে কিনেছে?’ বলল সে।
‘কে আর? তোর নানা। জীবনে কোনো দিন একটা ভালো দেখে তরমুজ কিনতে পারল না। বেছে বেছে পানসা তরমুজগুলো কিনে আনে লোকটা।’
ঠিক তখনই নানুর ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। ওড়নায় হাত মুছে টেবিলের ওপরে রাখা ফোন তুলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি। রুশা জানে কে ফোন করেছে—ওর বাবা। নির্বিকার ভঙ্গিতে পানসে তরমুজ খেতে লাগল সে। একটু পর নানু এসে বললেন, ‘তোর বাবা ফোন করেছিল।’
‘জানি।’
‘খুব টেনশন করছিল বেচারা।’
‘করুক।’
‘কেমন হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা! বুঝি না। যা, গোসল করে আয়। আমি খিচুড়ি বসাচ্ছি।’
চেয়ার ঠেলে উঠল রুশা। ঘরের দিকে এগোতেই ডাকলেন নানু।
‘অ্যাই! তোর হাঁটুতে কী হয়েছে?’
একটু অবাক হলো রুশা। নানু চোখে খুব ভালো দেখেন না। তারপরও হাঁটুর দিকে ঠিকই নজর গেছে তার। মা-বাবা হলে জীবনেও দেখতে পেত না। রুশা হেসে বলল, ‘কিছু হয়নি নানু। হাঁটুর জোর কত, পরীক্ষা করতে গিয়েছিলাম।’
‘আল্লাহ রে আল্লাহ! এই মেয়ে কী বলে কিছুই বুঝি না।’
গোসল শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল রুশা। নানুর বাসাটা এমন জায়গায়, বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তিন রুমের ছোট্ট একটা বাসায় থাকে নানা-নানু। অনেক পুরোনো, তারপরও রুশার মনে হয় এই বাসায়টায় প্রাণ আছে। নিজের বাসায় যা খুঁজে পায় না সে। মা-বাবার ওপর খুব রাগ হলো রুশার। কী এমন ব্যস্ততা তাদের? ছোটবেলা থেকেই একা একা থাকতে থাকতে একটা গাছের মতো হয়ে গেছে রুশা। সে যে সারা দিন একা একা থাকে, এটা নিয়ে মা-বাবার কোনো ভাবনা আছে? তাদের সব ভাবনা কাজ নিয়ে। মেয়েকে দেওয়ার মতো সময় তাদের নাই। কখনো বসে ১০টা মিনিট কথা বলে না। তাদের সঙ্গে আমার কথোপকথন অনেকটা সংসদের স্পিকার আর সাংসদের মতো। স্পিকারের মতো তাদের আছে নির্দিষ্ট কিছু তারকাচিহ্নিত প্রশ্ন, যেগুলো জিজ্ঞেস না করে শুধু নম্বর বললেই উত্তর দেওয়া যায়—
* স্কুলে গিয়েছিলে?
* কোচিংয়ে গিয়েছিলে?
* দুপুরে খেয়েছ?
* সন্ধ্যায় খেয়েছিলে কিছু?
* টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে, খেতে আসছ না কেন?
* কী ব্যাপার, এত রাতে ফোন নিয়ে জেগে বসে আছ কেন?
রোজ এই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে রুশা যে বিরক্ত, এটাও কি তারা বোঝে না? রুশার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঘরের দেয়ালে পোস্টার টাঙিয়ে রাখতে। যেখানে লেখা থাকবে—‘মা, বাবা, আমার সঙ্গে কথা বলো প্লিজ, এই প্রশ্নোত্তর পর্ব আমার ভালো লাগছে না।’ অবশ্য সে জানে মা-বাবা কখনোই তার কথা বুঝবে না। একবার তো জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমার কি মন খারাপ? স্কুলে বন্ধু আছে তোমার? কী নিয়ে কথা বলো ওদের সঙ্গে? ভালো লাগে? কী ভালো লাগে তোমার…’
এমনিতে ব্যাপারটার সঙ্গে ভালোই মানিয়ে নিয়েছে রুশা । কিন্তু তবু যখন মন খারাপ হয়, তখন ইচ্ছে করে মাকে ফোন করে কথা বলতে। স্কুলের দুষ্টু বান্ধবীর নামে বাবার কাছে নালিশ করতে। কিন্তু ফোন করলেই উত্তর আসবে, ‘আমি একটা মিটিংয়ে আছি, তোমাকে ফ্রি হয়ে কল দিচ্ছি।’ তাদের আর ফ্রি হওয়া হয় না।
রুশার মনে হয় সে আসলে পুরোনো একটা খেলনার মতো। যেমন তার ওয়ার্ডরোবের ওপরে রাখা লাল টেডি বিয়ারটা। ছোটবেলায় ওটা ছাড়া ভাতই খেত না রুশা। এখন এক কোনায় পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে বাতাসে নিচে পড়ে গেলে ঝেড়েটেড়ে আবার উঠিয়ে রাখে ওয়ার্ডরোবের কোনায়। এইটুকই।
সে আসলে মা-বাবার টেডিবিয়ার!
রুশার ভাবনায় ছেদ ঘটালেন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকা নানু। ‘রুশা, কথা বল। মার ফোন।’ ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন তিনি। অনিচ্ছা নিয়ে ফোনটা ধরল রুশা। ‘এসব কী পাগলামি করছ তুমি?’ ফোনের ওপাশ থেকে কড়া গলায় বললেন মা।
‘কী করছি?’ জিজ্ঞেস করল রুশা।
‘ডাক্তারের কাছে যাওনি কেন? তোমাকে স্কুল থেকে নিতে গেছে শাহ আলম, তুমি স্কুল থেকে বেরিয়ে গেছ। মানে কী এসবের?’
‘ডাক্তারের কাছে যেতে ভালো লাগে না।’
‘সবকিছু তোমার ভালো লাগার ওপর ডিপেন্ড করবে? নিজের ভালো বোঝো তুমি? বয়স কত তোমার?’
হঠাৎ শোরগোল শোনা গেল বাইরে। ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলেন ওসি সাহেব। তার পেছনে এসআই শাহ আলম আর কনস্টেবল আজিজুল। চমকে উঠে দাঁড়াল ভেতরে বসে থাকা সবাই৷
খট করে ফোন কেটে দিল রুশা। মায়ের এই সব কথা বিরক্ত লাগছে ওর। যা ইচ্ছা তা-ই বললেই হলো নাকি? একবার বলে, ‘তুমি কি ছোট বাচ্চা যে তোমাকে সব বুঝিয়ে দিতে হবে?’ আবার যখন তার প্রয়োজন, তখন বলে, ‘তুমি কি ছোট খুকি? বড় হয়েছ আর সাধারণ ব্যাপার বোঝো না?’
বিছানায় এসে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল রুশা। ফোনটা হাতে নিয়ে ঢুকল মেসেঞ্জারে। স্কুলের বান্ধবীদের গ্রুপে অ্যাড হয়েছে কয়েক দিন আগে। বেশ কয়েকটা মেসেজ দেখা গেল সেই থ্রেডে। স্ক্রল করতে করতে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল তার। একটা মেয়ে লিখেছে, ‘তোরা জানিস, বি সেকশনের ইভানকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’ কয়েকজন ‘ওয়াও’ রিঅ্যাক্ট দিয়েছে ওই মেসেজটায়। একজন আবার একটা মিমও শেয়ার করেছে। অভিনেতা মোশারফ করিমকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে—এ রকম একটা মিম। প্রচণ্ড বিরক্ত হলো রুশা। এই মেয়েগুলোর কোনো কমন সেন্স নেই। এদের জীবন আটকে আছে মিম আর রিঅ্যাকশনে। মেসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে গেল রুশা। ইভানকে ধরে নিয়ে গেল কেন, বুঝতে পারছে না সে। বেচারার তো কোনো দোষ নেই। ঠিক তখন ডাইনিং থেকে আদুরে গলায় ডাকলেন নানু, ‘রুশা, খেতে আয়।’
*
আগে কখনো থানায় আসেনি ইভান। নাটক–সিনেমার থানাগুলো যত গোছানো হয়, এটা মোটেও তেমন নয়। টেবিলে অগোছালো ফাইলের স্তূপ। রুমের বাইরে প্রচুর হইচই। একটু পরপর কল আসছে মানুষের মোবাইলে। সবাই খুব ব্যস্ত। নানা রকম কথা ভেসে আসছে ওয়াকিটকি থেকে, যার কোনোটাই ধরতে পারল না ইভান। অনেকক্ষণ ধরেই ওসি সাহেবের রুমে বসে আছে সে। পাশেই একটা চেয়ারে বসে আছে ফুপা-ফুপু। ওকে থানায় নিয়ে আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন ফুপা। হেডস্যার আর রমিজউদ্দীন স্যারও এসেছেন। সবাই চুপচাপ বসে আছে, কিন্তু কোনোভাবেই স্থির থাকতে পারছেন না ইভানের ফুপা। ৩ মিনিট পরপর উঠে পায়চারি করছেন। বাইরে যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন ভেতরে। ৫ মিনিট পরপর বাইরে বসা কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘ওসি সাহেব কখন আসবেন?’
বারবার বিরক্ত করার অপরাধে ফুপাকে হাজতে আটকে ফেললে অবাক হবে না ইভান। অসংখ্যবার একই প্রশ্ন করার বিস্ময়কর প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন ফুপা।
হঠাৎ শোরগোল শোনা গেল বাইরে। ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলেন ওসি সাহেব। তার পেছনে এসআই শাহ আলম আর কনস্টেবল আজিজুল। চমকে উঠে দাঁড়াল ভেতরে বসে থাকা সবাই৷ একপলকে সবাইকে দেখে নিজের চেয়ারে বসলেন ওসি সাহেব। আড়চোখে নেমপ্লেটের নামটা দেখে ফেলল ইভান—মোস্তাফিজ৷ তোয়ালে ঝোলানো বড় চেয়ারটায় বসার আগে ওসি মোস্তাফিজ বললেন, ‘এত লোক কেন এখানে? আপনারা প্লিজ বাইরে যান। আমি ডাকলে তারপর আসবেন।’
সবার সঙ্গে ইভানও বাইরে যাচ্ছিল। ওসি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ? বসো এখানে। বাকিরা বাইরে বসেন। শাহ আলম, তোমরাও যাও, বাকি কাজগুলো দেখো। আমি ডাকব তোমাদের।’
আবার বসে পড়ল ইভান। ভয় পাচ্ছে ও। ওসি মোস্তাফিজ চেয়ার টেনে একটু এগিয়ে এসে বললেন, ‘সকাল থেকে কী কী ঘটেছে বলো তো। ডিটেইল বলবা।’
‘জি স্যার।’ ঢোঁক গিলল ইভান। ‘প্রতিদিনের মতো আমি বাসা থেকে হেঁটে স্কুলে যাই। আজকে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন পৌঁছাই, ততক্ষণে অ্যাসেম্বলির লাইন শুরু হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে ব্যাগে রেখে আমিও অ্যাসেম্বলির লাইনে দাঁড়ালাম...’
‘আজকে দেরি হলো কেন? ইভানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ওসি। ওয়াকিটকি থেকে কথার শব্দ ভেসে আসছে।
‘আজকে...’ ইতস্তত করল ইভান। দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। ‘স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে একটা বিড়াল দেখেছিলাম। বাচ্চা বিড়াল। পথ হারিয়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছিল। আমার মনে হলো, বিড়ালটা যেকোনো সময় গাড়ির নিচে পড়তে পারে। বিড়ালটাকে ব্যাগে নিয়েই স্কুলের দিকে রওনা দিলাম আমি৷ আমাদের স্কুলের সামনে একটা চায়ের দোকান আছে। দোকানদার মামার কাছ থেকে একটা বাক্স ম্যানেজ করলাম। বিড়ালটা ওই বাক্সে ভরে দোকানের নিচে রেখে এসেছি। দোকানদার মামাকে বলেছি দেখে রাখতে, স্কুল থেকে যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। এই জন্য দেরি হয়ে গিয়েছিল৷’
‘আচ্ছা। তারপর কী হলো?’
‘অ্যাসেম্বলি শেষে আমরা ক্লাসে গেলাম। রোলকল হচ্ছিল। হঠাৎ জাকির মামা এসে আমার ব্যাগ খুললেন।’
‘জাকির মামাটা কে?’
‘আমাদের স্কুলের দপ্তরি।’
‘ওকে। বলতে থাকো।’
‘আমি জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাগ চেক করছেন কেন? উনি কোনো জবাব দিলেন না। পুরো ব্যাগ চেক করতে লাগলেন৷ তারপরই ছুরিটা বের করলেন ব্যাগ থেকে। ব্যাগে ছুরি কীভাবে এল আমি কিছুই জানি না। কিন্তু স্যার আমার কথা বিশ্বাস করলেন না৷ আমাকে হেডস্যারের রুমে নিয়ে গেলেন।’
‘তোমার কী মনে হয়? ছুরি আসল কীভাবে?’
‘আমি জানি না স্যার।’
ওসি মোস্তাফিজ টেবিলে রাখা বেল চাপলেন। দ্রুত ছুটে এল একজন কর্মচারী। ‘এই ছেলের ব্যাগটা নিয়ে এসো।’ কর্মচারীকে বললেন ওসি। একটু পরই ব্যাগটা নিয়ে হাজির হলেন সেই কর্মচারী। হাতে রাখা আরেকটা প্লাস্টিকের ব্যাগের ভেতর ছুরি, যেটা পাওয়া গেছে ইভানের ব্যাগে। ওসির ইশারায় টেবিলের ওপর ব্যাগটা রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন পাশে। মনোযোগ দিয়ে ব্যাগটা দেখলেন ওসি মোস্তাফিজ। পাশে রাখা বাক্স থেকে গ্লাভস বের করে পরে ফেললেন দ্রুত। তারপর ব্যাগটা নেড়েচেড়ে দেখলেন ভালো করে। বিড়ালের বিষয়টা সত্যি বলেই ধরে নিলেন তিনি। ব্যাগে বিড়ালের লোম দেখা যাচ্ছে।
‘তোমার সঙ্গে কারও ঝামেলা আছে? মারামারি করেছ কারও সাথে?’ গ্লাভস খুলতে খুলতে বললেন ওসি মোস্তাফিজ।
‘জি না স্যার।’ মাথা নেড়ে বলল ইভান।
‘রোল নম্বর কত তোমার?’
‘১৩।’
‘লেখাপড়ার পাশাপাশি আর কী কী করো?’
‘ক্রিকেট খেলি৷ বই পড়ি। গিটার শিখি।’
‘লাস্ট কী বই পড়েছ?’
‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।’
‘শীর্ষেন্দু?’
‘জি স্যার।’
‘খুব ভালো। কিন্তু তুমি যেখানে জড়িয়েছ, সে ব্যাপারটা খুব একটা ভালো না। বুঝতে পারছ?’
‘জি।’
টেবিলে রাখা বেল চাপলেন ওসি মোস্তাফিজ। দ্রুত ছুটে এলেন কর্মচারী। ‘শাহ আলমকে ডাকো৷’ বললেন ওসি। একটু পরই ভেতরে এসে স্যলুট দিলেন এসআই শাহ আলম। ‘স্যার, বলেন স্যার।’
‘তোমার ব্যাগে যে ছুরিটা পাওয়া গেছে, সেটা একটা খুনের সম্ভাব্য আলামত। আমার ধারণা, তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তোমাকে আলাদা করে বোঝানোর কিছু নেই। সো, ডিরেক্ট আনসার দাও। এককথায় উত্তর। তোমার ব্যাগে ছুরিটা এল কী করে?’
‘আমি জানি না স্যার।’
‘ছুরিটা তুমি আগে দেখেছ?’
‘জি না। কখনো দেখিনি।’
‘তুমি গোয়েন্দা কাহিনি পড়ো নিশ্চয়ই?’
‘জি, পড়ি।’
‘জানো তো, ফিঙ্গারপ্রিন্ট টেস্ট করলেই বেরিয়ে আসবে ছুরিটায় কার কার হাত ছিল...’
‘আমি এটা টাচও করিনি। আমি জানতাম না ওটা আমার ব্যাগে ছিল...’
মোবাইলের রিংটোন শুনে চমকে উঠল ইভান। ওসি মোস্তাফিজের সামনে রাখা দুটো ফোনের একটার রিংটোন বাজছে। ফোনটা ধরলেন ওসি।
‘মা তুমি ধরো না কেন? ডাক্তারের কাছে যাওনি, তোমার আঙ্কেলরা তোমাকে স্কুলে নিতে গেল, তুমি স্কুলে নাই। ফোনও ধরো না, ব্যাপারটা কী?’
‘বাবা!’ ওপাশ থেকে বলল রুশা।
‘বলো।’
‘তোমরা ইভানকে ধরে এনেছ কেন? ও কিছু করেনি। আমি ওকে বলেছিলাম হেল্প করতে।’
‘মানে? তুমি ওকে চেনো?’
‘হ্যাঁ। ও আমার ফ্রেন্ড। ওকে যেতে দাও।’
‘আচ্ছা, আমি দেখছি কী করা যায়। তুমি নানুর ওখানে থাকো। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। বাসায় আসো।’
‘আগে ওকে ছাড়ো। তারপর।’
‘হ্যালো...’
ফোন রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন ওসি মোস্তাফিজ। ইভানের দিকে তাকালেন কড়া চোখে।
‘তুমি তো খুব চালাক ছেলে। তোমাকে বলেছিলাম কিছু লুকাবে না। ডিটেইল বলবে। রুশার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে, তুমি ওকে স্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে হেল্প করেছ—এটা বললে না কেন?
ইভান মাথা নিচু করে রইল চুপচাপ।
টেবিলে রাখা বেল চাপলেন ওসি মোস্তাফিজ। দ্রুত ছুটে এলেন কর্মচারী। ‘শাহ আলমকে ডাকো৷’ বললেন ওসি।
একটু পরই ভেতরে এসে স্যলুট দিলেন এসআই শাহ আলম। ‘স্যার, বলেন স্যার।’
ইভানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ওসি মোস্তাফিজ বললেন, ‘এই ছেলের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার ব্যবস্থা করো। দ্রুত।’
‘জি স্যার।’
সজোরে স্যালুট ঠুকে চলে গেলেন এসআই শাহ আলাম। স্যালুটের শব্দে বুক কেঁপে উঠল ইভানের। মনে হলো, ধীরে ধীরে আরও শক্ত জালে আটকে যাচ্ছে সে।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619।