‘তোমরা দাঁড়াও এখানে, আমি দেখি সিএনজি পাই কি না।’ বলেই সামনে এগোলেন ইভানের ফুফা। থানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে ইভানরা। ইভানের হাত ধরে আছেন ফুফু। হেডস্যার আর রমিজউদ্দীন স্যারও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হেডস্যার ফুফুকে বললেন, ‘আপা, আমরা আসি। ওকে বাসায় নিয়ে যান। সারা দিন অনেক ধকল গেছে ওর ওপর। খাওয়াদাওয়া হয়নি।’
‘কী বলেন! আপনারাও যাবেন আমাদের বাসায়।’ ফুফু বললেন। ‘অনেক কষ্ট করলেন। একটু ডাল-ভাত খাবেন আমাদের সঙ্গে।’
—না না, আমাদের আবার স্কুলে যেতে হবে। কিছু কাজ আছে। তারপর বাসা। আপনারা যান। আরেক দিন এসে ভরপেট খেয়ে যাব।
ইভানের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সামনে এগোলেন হেডস্যার আর রমিজউদ্দীন স্যার। কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে এলেন হেডস্যার । ফুফুর দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললেন, আপা, আরেকটা কথা, আপাতত এ কয়দিন ও বাসায় থাকুক। স্কুলে আসার দরকার নেই।
—কেন? ফুফুর কণ্ঠে বিস্ময়।
—না মানে, কয়েকটা দিন যাক। বিশ্রাম নিক। ট্রমাটা কাটুক। তারপর স্কুল, কী বলো ইভান?
—আপনি যা বলবেন স্যার।
—গুড। কয়েক দিন ছুটি কাটাও। ঠিক আছে? ওকে, গেলাম আমরা। আপা, ভালো থাকবেন। আসবেন স্কুলে। আসি।
একটা সিএনজি অটোরিকশা এসে থামল থানার গেটে। ভেতরে বসা ইভানের ফুফা চড়া গলায় ডাকলেন, ‘কই, আসো।’
ইভানকে নিয়ে দ্রুত সিএনজিতে উঠে গেলেন ফুফু। হেডস্যারদের সামনে দিয়েই ভটভট শব্দে চলে গেল সিএনজি অটোরিকশা।
ডান পাশে বসেছেন ফুফা, মাঝখানে ফুফু। ইভান বসেছে বাঁ পাশে। কারও মুখে কথা নেই। সিএনজিচালক বললেন, ‘ভাই, সার্জেন জিগাইলে কইয়েন মিটারে যাইতেছি।’
‘আচ্ছা।’ বললেন ফুফা। ‘মিটারে যাও না কেন তোমরা? আর যাবে না যখন, মিটার রাখারই বা কী দরকার? ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দিলেই তো হয়।’
—কী কন স্যার! ডেইলি জমা কত জানেন? গ্যাসের খরচ, জমা এইখানেই তো ট্যাকা শ্যাষ। খামু কী?
—গাড়ি তোমার না?
—না, মালিকের। মালিকের বাড়ি মমেনসিং।
—ময়মনসিংহের কোথায় বাড়ি...?
ফুফা আর সিএনজিচালকের কথায় মাথা ধরে যাচ্ছে ইভানের। ফুফা এখন এত স্বাভাবিক আচরণ করছেন, যেন কিছুই হয়নি। ইভানরা দুপুরে খেতে সবাই মিলে থানায় গেছে। খাওয়া শেষে এখন ফিরছে বাসায়। অথচ সারা দিন এত ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটেছে, স্থির হয়ে কিছু ভাবার সুযোগই পায়নি ইভান। প্রথম ক্লাসেই ব্যাগে ছুরি, হেডস্যারের রুমে যাওয়া, রুশার সঙ্গে দেখা, তারপর থানায় আসা, তদন্ত, আঙুলের ছাপ—সব মিলিয়ে একটা ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিল ইভান।
‘ওসি সাহেব মানুষটা ভালোই মনে হলো, তা–ই না বলো?’ ফুফু বললেন।
‘হ্যাঁ। তবে খুব কড়া।’ জবাব দিলেন ফুফা। ‘এই থানায় এসেছেন বেশি দিন হয়নি। এ জন্যই চিনতে পারেননি আমাকে। আগের ওসির সঙ্গে তো আমার ভালো সম্পর্ক ছিল।’
‘১০০ পার্সেন্ট মিথ্যা কথা,’ মনে মনে বলল ইভান। ‘থানার ভেতর একেবারে মুরগি হয়ে ছিলেন ফুফা। এখন বের হওয়ামাত্র তাঁর টেপ রেকর্ডার অন হয়ে গেছে। অদ্ভুত একটা লোক।’
ফুফু ইভানের হাত ধরে বললেন, ‘ইভান, বাবা, তুই ভুলেও ছুরিটায় হাত দিসনি তো?’
—না।
—আঙুলের ছাপ পাওয়া না গেলেই ওরা বুঝবে তুই নির্দোষ।
‘অত সহজ নাকি?’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন ফুফা। ‘এই ছুরি দিয়ে একটা লোককে খুন করা হয়েছে। তোমার ভাইপো অত সহজে ছাড়া পাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টা ওকে নজরদারির মধ্য রাখবে পুলিশ। সেই সঙ্গে আমাদেরও। পুলিশকে তো চেন না। আগেই বলেছিলাম, এই ছেলেকে কোনো আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দাও। একদম সোজা থাকত। এই সব ছুরিটুরির ঝামেলায় পড়তে হতো না।’
—তুমি থামো তো। উল্টপাল্টা কথা বলো না। ও কিছু করেছে নাকি? ওকে ফাঁসাতে কেউ ছুরি রেখে দিয়েছে ব্যাগে।
—আমরাও তো স্কুলে পড়েছি। কই, আমাদের ব্যাগে ছুরি দূরে থাক, একটা কাঠি পর্যন্ত ছিল না। এমন ছেলেদের সঙ্গে মেশে কেন যারা ছুরি রেখে দেয়? কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
‘ব্যাগের ভিতরে ছুরি রাখছে?’ সিএনজিচালক পেছনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
বাবার সঙ্গে কথা বলার পর নির্ভার হলো ইভান। বাবা দেশে থাকলে ওর কোনো চিন্তাই থাকত না। আর যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে তো কথাই ছিল না। ফোন হাতে নিল ইভান। মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে বেশ কিছু। অনেকেই জানতে চেয়েছে ঘটনাটা সত্যি কি না।
‘তুমি সামনে তাকাও।’ ধমক দিলেন ফুফা। ‘আমাদের কথায় তুমি ঢুকছ কেন? ঠিকমতো চালাও, নইলে ম্যানহোলে পড়বে। অনেক সিএনজিকে আমি ম্যানহোলে পড়তে দেখেছি।’
সিএনজি থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে শান্তি পেত ইভান। কিন্তু উপায় নেই। ছোট্ট এই জিনিসটাকে চলমান একটা কারাগারের মতো মনে হচ্ছে ওর কাছে। ছোট একটা খাঁচা, দুপাশ থেকে দরজা আটকানো। দরজার ছিটকিনি চালকের হাতে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কোনো অপরাধীকে যদি ফুফার সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়, অপরাধী বিরক্ত হয়েই সব দোষ স্বীকার করে নেবে।
নিজের জিজ্ঞাসাবাদের কথা মনে পড়ে গেল ইভানের। ওসি মোস্তাফিজ কি সন্দেহ করছেন ওকে? বিশ্বাস করেননি কোনো কথা? উনি যখন টের পেলেন, রুশার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেছে ইভান, যেভাবে কড়া চোখে তাকালেন, ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠেছিল ওর। তারপর যখন পুরো ঘটনাটা বলল ইভান, কেমন যেন হয়ে গেলেন। রুশার ব্যাপারে আর কিছুই বললেন না। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনকই লাগছে ইভানের কাছে।
বাসার কাছে এসে থামল সিএনজি। বিল্ডিংয়ের ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে রাস্তায়। ওদের মুখোমুখি না হতে গেট খুলতেই দ্রুত ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল ইভান। ‘ইভান ভাইয়া, খেলবে না?’ জিজ্ঞেস করল একজন। ‘না’ বলে সবার আগে বাসার দরজা খুলে নিজের ঘরে চলে গেল সে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সব প্রতিবেশীর কানে পৌঁছে গেছে ছুরি আর থানায় যাওয়ার বিষয়টা। এ নিয়ে এখন আর কথা শুনতে চায় না ইভান।
স্কুলব্যাগটা একপাশে ফেলে চেয়ারের ওপর মেলে দেওয়া গামছা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল ইভান। ভালোমতো একটা গোসল দরকার। মাথায় পানি ঢালামাত্র সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভেসে উঠল ওর চোখে। আশ্চর্য, বন্ধুদের কেউ এখন পর্যন্ত একটা ফোন করে খোঁজও নিল না! ভাবল ইভান।
গোসল শেষ করে বের হতেই খেতে ডাকলেন ফুফু। কোনোমতে খাবার খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল পাঁচ মিনিটেই।
ইভানের ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। ওর বাবা ফোন করেছেন। ফোন ধরবে কি না, তা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভাবল ইভান। ধরেই ফেলল শেষমেশ।
—হ্যালো বাবা।
—কী বাবা, কেমন আছ তুমি?
—ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
—এই তো, আছি। স্কুলে গিয়েছিলে?
—হ্যাঁ।
—সব ঠিকঠাক?
—না বাবা। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।
—কী হয়েছে?
পুরো ঘটনা খুলে বলল ইভান। কিছুই বাদ দিল না। ঘটনা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন ইভানের বাবা। বললেন,
—কাজটা কে করল?
—জানি না।
—পুলিশ তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?
—না না। ভালোভাবেই কথা বলেছে।
—কী বলল ওরা?
—আঙুলের ছাপ নিল। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে জানাবে। আর বলল, আপাতত কোথাও যেন না যাই।
—চিন্তা করিস না। তোর তো কোনো দোষ নেই, আমি জানি। এগুলো নিয়ে ভাববি না একদম। ঠিক আছে?
—হ্যাঁ বাবা।
—তোর ফুফুর কথা শুনিস। আর ফুফার কথায় কিছু মনে করিস না। বিশ্রাম নে। আবার কাল ফোন করব।
বাবার সঙ্গে কথা বলার পর নির্ভার হলো ইভান। বাবা দেশে থাকলে ওর কোনো চিন্তাই থাকত না। আর যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে তো কথাই ছিল না। ফোন হাতে নিল ইভান। মেসেঞ্জারে মেসেজ এসেছে বেশ কিছু। অনেকেই জানতে চেয়েছে ঘটনাটা সত্যি কি না। স্ক্রল করে করে সব মেসেজ পড়ল ইভান। উত্তর দিল কয়েকটার। কিন্তু রাহাত কোনো মেসেজ দেয়নি দেখে অবাক হলো সে। আজ ওর পাশেই বসেছিল রাহাত। ক্লাসে যারা ভালো ছাত্র, তাদের বন্ধু হয় ভালো ছাত্ররা। যারা খারাপ ছাত্র, তাদের বন্ধু হয় খারাপ ছাত্ররা। আর ঝামেলায় পড়ে আমার মতো মাঝারি ছাত্ররা। ভালো ছাত্রদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয় না, আবার খারাপ ছাত্রদের সঙ্গেও মেলে না। নইলে বন্ধুদের কেউ খবর নিল না কেন? একটা ফোন তো করতে পারত। আমি হলে তো সোজা চলে যেতাম বাসায়। ভাবল ইভান।
একে একে মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রামের মতো সব অ্যাপ দেখে ফেলল। অযথাই কিছু রিল দেখল। কিন্তু খুব একটা ভালো লাগল না আজ। মুঠোফোন রেখে চোখ বন্ধ করল ইভান। ভাবতে লাগল কাজটা কার। যে লোক খুন হয়েছেন, তিনি-ই বা কে? যদি এই ছুরি দিয়েই লোকটাকে খুন করা হয়ে থাকে, তাহলে ছুরিটা ইভানের ব্যাগে এল কী করে? ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল ইভান।
বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল ইভানের। ঝুমবৃষ্টি নেমেছে। জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখল ইভান। তখনই মনে পড়ল, গতকাল চায়ের দোকানের নিচে বিড়ালের বাচ্চাটাকে একটা বাক্সে রেখে দিয়ে এসেছিল সে। বলে এসেছিল, ছুটির পর নিয়ে যাবে। তারপর সারা দিনের ঝামেলায় আর নিতে পারেনি। বিড়ালটা কি এখনো দোকানের নিচেই আছে? থাকলে তো বৃষ্টিতে ভালো ঝামেলায় পড়বে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল ইভান। দুটো বিস্কুট মুখে দিয়ে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোল সে।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’ রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন ফুফু।
—স্কুলের দিকে।
—না, বের হওয়ার দরকার নেই। বাইরে বের হলে আবার কী ঝামেলা হবে তার নেই ঠিক।
—কোনো ঝামেলা হবে না। যাব আর আসব।
—কেন যাবি?
—একটু দরকার আছে। গিয়েই চলে আসব।
—অসম্ভব। চুপচাপ ঘরে বসে থাক। গল্পের বই পড়। বাইরে যাওয়া যাবে না।
—আচ্ছা, ঠিক আছে।
স্যান্ডেল খুলে আবার ঘরে চলে এল ইভান। মুঠোফোন নিয়ে বসল বিছানায়। মেসেঞ্জার খুলতেই বিস্মিত হয়ে গেল ইভান। গতকাল যারা সহানুভূতি দেখিয়েছিল ওর ইনবক্সে, তারাই অন্যদের সঙ্গে ট্রল করেছে ইভানকে নিয়ে। কয়েকজন আবার সেগুলোর স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে ইভানকে। রাগে গা জ্বলছে ওর। এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার কোনো মানে হয় না, ভাবল সে।
ঘর থেকে আবার বের হলো ইভান। ফুফু রান্নাঘরের ভেতর। পা টিপে টিপে ডাইনিং পেরিয়ে গেল ইভান। খুব ধীরে দরজা খুলল সে। কোনো রকম শব্দ না করেই দরজা লাগিয়ে দিল চুপচাপ। তারপর দ্রুত নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। এমনিতে হেঁটেই স্কুলে যায় ইভান। কিন্তু এখন ঝুমবৃষ্টি। অনেকক্ষণ পর একটা রিকশা পাওয়া গেল। স্কুলের দিকে রওনা দিল ইভান। একেবারে চায়ের দোকানটার সামনেই এসে থামল রিকশা। ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেল ইভান। দোকানদার ইভানকে দেখেই বললেন, ‘যে ঝামেলায় ফালাইলা আমারে! সারাটা রাইত জ্বালাইয়া মারসে তোমার বিলাই।’
—আমি নিজেই ছিলাম ঝামেলায়। তাই আসতে পারিনি।
—ধুর মিয়া। জানাইবা না?
—বিড়ালটা কোথায়?
—জানি না। অনেক জ্বালাইতেছিল। দিসি ফালাইয়া।
—এটা কী করলেন মামা? আপনার কাছে দিয়ে গেলাম, আপনি একটু রাখতে পারলেন না? কোথায় ফেলেছেন?
—আরে মিয়া, আমি দোকান সামলাইয়া কূল পাই না, এইসব বিলাই মিলাই কখন সামলামু? ওইদিকে ফালাইসি।
কোনো কথা না বলে হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল ইভান। ভীষণ রেগে গেছে ও। পেছন থেকে দোকানদার ‘এই ইবান...ইবান...’ বলে ডাকলেন, পাত্তাই দিল না ইভান। দোকান থেকে বেরিয়ে ইভানের পেছন পেছন ছুটলেন তিনি। হাত ধরে থামালেন ওকে।
—আরে দাঁড়াও না মিয়া। রাগ দেখাইলে চলব?
—আপনি বিড়ালটা ফেলে দিলেন কেন?
—ফেলি নাই। দোকানেই আছে। তোমারে একটু লাড়া দিলাম।
দোকানদারের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল ইভান। ‘আসো, দোকানে আসো। হুদাই বৃষ্টিতে ভিজাইলা আমারে। এমনেই আমার ঠান্ডার সমস্যা।’ ইভানের হাত ধরে দোকানে নিয়ে এলেন তিনি। ইভান বেঞ্চে বসতেই দোকানের ভেতর থেকে কাগজের বাক্সটা বের করলেন দোকানদার। ‘মিউ মিউ’ করে নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দিল বিড়ালটা। বাক্সটা কোলে নিয়ে ঢাকনাটা উঠিয়ে ভেতরে তাকাল ইভান। বিড়ালটা কী সুন্দর! পুরো শরীরটা সাদা। মাথার এক পাশে সাদা, এক পাশে কালো। এত নিখুঁত, দেখে মনে হয় কেউ স্কেল দিয়ে মেপে সাদা-কালো রং করেছে বিড়ালটার মাথায়।
‘এইটারে দোকানে রাইখা গেসিলাম রাইতে।’ চা বানাতে বানাতে বললেন দোকানদার। ‘সকালে দোকানে আইসা দেখি, পুরা দোকান তছনছ কইরা ফালাইসে বিলাই। খালি তুমি রাখতে কইসো বইলা কিছু কইলাম না। নাইলে আছাড় দিয়া ফালাইয়া দিতাম ওরে। শয়তান বিলাই।’
রাহাতের বাসা থেকে বেরিয়ে এল ইভান। ও জানে, রাহাত বাসায়ই আছে। রাহাতের স্যান্ডেল, স্কুলের জুতা দুটোই জুতার র্যাকে। মিথ্যা বলেছে রাহাতের ছোট ভাই। ব্যাপারটা কী? দেখা করতে চাইছে না কেন? দ্রুত হিসাব মেলাল ইভান।
আবারও হাসল ইভান। সে জানে, দোকানদার রিপন মামার মনের কথা নয় এটা। এর আগে বেশ কয়েকবার বিড়াল–কুকুর উদ্ধার করে রিপন মামার কাছে এনে রেখেছে ইভান। মুখে বিরক্তি প্রকাশ করেন, দায়িত্ব নিতে চান না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর না করতে পারেন না। এবারও পারেননি। সব জেনেও মাথা গরম করায় খারাপই লাগছে ইভানের। তবে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে দ্রুতই সে ভুলে গেল ব্যাপারটা।
—অহন এইটারে কই লইয়া যাইবা?
—বাসায়।
—আবার বাসায়? আবার চেতব তোমার ফুফা-ফুফু।
—এখন তো আমার স্কুল নেই, আপাতত আমার ঘরেই রাখতে পারব।
—হ, আমি আবছা আবছা শুনসি ঘটনা। হইল কেমনে জিনিসটা? কাউরে সন্দেহ করো?
—না, ও রকম কারও কথা তো মাথায় আসছে না। আচ্ছা মামা, আসি আজকে।
—চা খাইবা না?
—আরেক দিন।
বৃষ্টি থেমে গেছে প্রায়। এবার আর রিকশা নয়, বাক্সটা নিয়ে হেঁটেই এগোল ইভান। সবাই স্কুলের দিকে যাচ্ছে, ও যাচ্ছে উল্টো দিকে। স্কুলগামী অনেকেই ফিরে তাকাচ্ছে ওর দিকে। বৃষ্টিতে ভেজা জামা, হাতে একটা বাক্স নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা ছেলে, তাকানো স্বাভাবিক। হঠাৎ একটা রিকশা এসে থামল ইভানের ঠিক সামনে। রিকশা থেকে নামল সাকিব। ইভানদের ক্লাসেই পড়ে ও। সাকিব বলল, ‘কী রে, ইভান! স্কুলে আসবি না?’
—না, আপাতত কয়েক দিন আমার ছুটি।
—তোর সঙ্গে এই ঘটনা, ওই দিকে রাহাতও কোচিংয়ে আসেনি, ফোন বন্ধ...ব্যাপার কী রে?
—কোচিংয়ে যায়নি?
—নাহ। ওর তো ফেসবুকও ডিঅ্যাকটিভ দেখলাম।
—তা–ই নাকি!
—কী যে হচ্ছে, বুঝলাম না। শুনলাম, তোকে নাকি টিসি দিবে দেবে?
—কার কাছে শুনলি?
—স্যাররা বলাবলি করছিল কাল। তোকে কিছু বলেনি?
—না তো।
—পুলিশ তোকে ছেড়ে দিল? মারধর করেছে?
—আরে মারবে কেন? আমি কিছু করেছি নাকি? কথা বলেছে। জানতে চেয়েছে।
—ও, না, কেউ কেউ বলছিল আরকি। আমি বিশ্বাস করিনি। আমি তো জানি, তুই ও রকম ছেলেই না।
—আচ্ছা, আমি যাই।
বাসার দিকে যেতে যেতে রাহাতকে কল দিল ইভান। রিং হলো অনেকবার, ধরল না রাহাত। ঘুরে রাহাতের বাসার দিকে হাঁটা দিল ও। বিল্ডিংয়ের নিচে এসে কলবেল চাপল। দরজা খুলল রাহাতের ছোট ভাই।
—রাহাত আছে বাসায়?
—না, ও তো বাসায় নেই।
—এলে বোলো আমাকে ফোন করতে।
—আচ্ছা।
রাহাতের বাসা থেকে বেরিয়ে এল ইভান। ও জানে, রাহাত বাসায়ই আছে। রাহাতের স্যান্ডেল, স্কুলের জুতা দুটোই জুতার র৵াকে। মিথ্যা বলেছে রাহাতের ছোট ভাই। ব্যাপারটা কী? দেখা করতে চাইছে না কেন? দ্রুত হিসাব মেলাল ইভান। অ্যাসেম্বলির সময় ও যখন বেঞ্চে ব্যাগ রেখেছিল, তখন রাহাতের ব্যাগ ছিল না ওখানে। ইভানেরও পরে এসেছে রাহাত। তারপর গিয়েছে অ্যাসেম্বলিতে। এসেছে সবার পরে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল ইভানের। কাজটা তাহলে রাহাতই করেছে? কেন?
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619।