দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

‘ভাই, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন? আমার বাসা তো উল্টো দিকে।’ চেঁচিয়ে বলল রাহাত। তীব্রগতিতে ছুটছে বাইক। রাহাতের কথার কোনো জবাব না দিয়ে গিয়ার বদলাল জিকো। বিকট শব্দ করে আরও জোরে এগিয়ে গেল বাইকটা। বাতাস এসে ঝাপটা মারছে রাহাতের মুখে। মাঝে মাঝে চোখেমুখে ধুলা এসে লাগছে বাতাসের সঙ্গে। জিকোর বন্ধুদের বাইকটা আসছে পেছন পেছন। মাঝেমধ্যে এগিয়ে আসছে ওদের পাশে। চোখাচোখি হচ্ছে জিকোর সঙ্গে। বাইক দুটি এত কাছাকাছি চলে আসছিল যে রাহাতের মনে হচ্ছিল, পাশাপাশি ধাক্কা খাবে ওরা। পরক্ষণেই জোরে পিকআপ দিয়ে একবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে জিকো। একটু পর আবার পাশে আসছে পেছনে থাকা বাইকটা। পেছনের বাইকের দুজনই হেলমেট পরা। ভিউ মিররে দেখেও রাহাত চিনতে পারছে না ওদের। জিকো আর তপুর মাঝখানে বেকায়দায় বসে আছে সে। বাইকের দুই পাশে পা রাখার যে জায়গা, সেখানে ওর সঙ্গে পা রেখেছে তপুও। দুজনের মাঝখানে চ্যাপ্টা হয়ে বসে ঠিকমতো পা-ই রাখতে পারছে না রাহাত। ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে পায়ে। তার ওপর পিঠের সঙ্গে একেবারে লেগে আছে তপু। কোনোমতে একটু সামনে ঝুঁকে ঘাড় কাত করল রাহাত। বাতাসের বিপরীতে চেঁচিয়ে বলল আবার, ‘ভাই, আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে। বাইক ঘোরান।’

পাত্তাই দিল না জিকো। রাহাতের কথাটা বাতাসে মিলিয়ে গেল যেন। হাল ছাড়ল না রাহাত। আবার চেঁচিয়ে বলল, ‘আমার কোচিং আছে ভাই। বাইক ঘোরান। নইলে নামায় দেন আমাকে।’

পেছন থেকে খপ করে রাহাতের ঘাড় চেপে ধরল তপু। পেছন থেকে এক ধাক্কায় ওকে সোজা করে বসিয়ে তপু বলল, ‘কিরে বেয়াদব, বাইক রানিংয়ে আছে, তা–ও ডিস্টার্ব করতাসোস?’

‘ডিস্টার্ব করলাম কোথায়?’ ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করল রাহাত।

রাস্তার মাথায় বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে রিকশার জটলা। পাশপাশি দুটো রিকশার চাকার স্পোক লেগে গেছে একটা আরেকটার সঙ্গে। কার দোষ, তা নিয়ে ঝগড়া করছে দুই রিকশাচালক। এর মধ্যে একটা রিকশা তাদের পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছিল রাস্তার মাঝখান দিয়ে।

‘চলন্ত অবস্থায় চালকের লগে কথা বলা নিষেধ, তা জানোস না? টিভি-টুভি দেখোস? নাকি খালি হোমওয়ার্ক করোস ফার্মের মুরগির মতো? চুপচাপ বইসা থাকবি। বেশি লাড়াচাড়া করলে একদম ধাক্কা মাইরা ফালায় দিমু রাস্তায়। সীমানার বাইরে চইলা যাবি।’

‘আপনি গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন? হাত সরান।’

‘আবার কথা কস!’ ঘাড়ে রাখা হাতের চাপ আরও বাড়াল তপু।

‘এই তপু, রিল্যাক্স ম্যান।’ বাইকের ভিউ মিররে আড়চোখে দেখে বলল জিকো। ‘বাচ্চা ছেলে, একটামাত্র ঘাড়, সেটাও ত্যাড়া হইয়া গেলে প্যারা হয়ে যাবে। ছাড়।’

জোরে একটা ঝাঁকি দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল তপু। পেছনে যতটুকু ঘোরা সম্ভব ঘুরল রাহাত। তারপর কড়া চোখে তাকিয়ে রইল তপুর দিকে। মুখ বাঁকা করে বিশ্রী একটা শব্দ করল তপু। ইশারায় বলে দিল, ‘সামনে তাকা।’

সামনে তাকাল রাহাত। বাইকে আলাদা করে লাগানো সাইলেন্সার পাইপ থেকে ভটভটভট শব্দ হচ্ছে। সাঁই করে দোকানপাট, মানুষজনকে পেরিয়ে যাচ্ছে বাইকটা। রাস্তার লোকজন একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে নিজের কাজে। রাহাত মনে মনে চাইছে, বাইকটা সামনের সিগন্যালে পড়ুক। একটা বাইকে তিনজন বসা নিষেধ। সার্জেন্টের চোখে পড়লে নিশ্চয়ই আটকাবে ওদের। তখন নিশ্চয়ই সবাইকে বাইক থেকে নামতে বলবে। নামার সঙ্গে সঙ্গে ঝেড়ে দৌড় দিতে হবে—মনে মনে ঠিক করে রাখল রাহাত।

আরও পড়ুন

রাস্তার মাথায় বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে রিকশার জটলা। পাশপাশি দুটো রিকশার চাকার স্পোক লেগে গেছে একটা আরেকটার সঙ্গে। কার দোষ, তা নিয়ে ঝগড়া করছে দুই রিকশাচালক। এর মধ্যে একটা রিকশা তাদের পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছিল রাস্তার মাঝখান দিয়ে। রিকশাটার পেছনে পড়ায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য গতি কমাতে বাধ্য হলো জিকো। বিকট শব্দে হর্ন দেওয়া শুরু করল সে। তখনই দুই পাশ থেকে ঘুরে পেছনে তাকাল রিকশার দুই যাত্রী। চমকে উঠল রাহাত। আরে, এ তো আলভী আর রাজন! দুজনই রাহাতের ক্লাসে পড়ে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে ওরা। জিকোর সঙ্গে একটা বাইকে রাহাতকে দেখে অবাক হলো দুজনই। ওদের দেখেই আর একটুও দেরি করল না জিকো। গিয়ার বদলে ফেলল দ্রুত। বাড়িয়ে দিল গতি। হর্ন বাজিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওভারটেক করে সোজা এগোল এফজেডএস টু। মেইন রোড থেকে আচমকা গলিতে ঢুকে পড়ল জিকো। পেছনে তাকিয়ে শুধু বন্ধুদের বিস্মিত চোখ দেখতে পেল রাহাত। কিছু বলার সুযোগই পেল না।

গলিতে ঢোকার পরও গতি কমাল না জিকো। জোরে বাইক চালানো ওর অভ্যাস। তীব্রগতিতে একটা বাইক চলতে দেখলে আশপাশের মানুষ চমকে যায়। একবার হলেও তাকায় বাইকের দিকে—এটা নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে ওর—ভাবল রাহাত। কিন্তু বাইকটা দৃষ্টিসীমানা পেরিয়ে গেলেই যে ‘অসভ্য’ বলে গলি দিয়ে বসে মানুষ, তা তো আর জিকোর মতো বাইকারদের কানে যায় না। ওরা বোধ হয় ভাবে, খুব একটা হিরোগিরি করা হলো।

ফোন বেজে উঠল রাহাতের। ফোন বের করার জন্য পকেটে হাত ঢোকাল ও। সঙ্গে সঙ্গেই পেছন থেকে শক্ত করে রাহাতের হাত চেপে ধরল তপু। রাহাত পেছনে তাকাতেই ইশারায় বুঝিয়ে দিল তপু, ফোন ধরা যাবে না।

একটু পর আবার বেজে উঠল ফোন। ‘কে কল দিচ্ছে?’ ভাবল রাহাত। ‘আম্মু নিশ্চয়ই।’ এবারও ফোন ধরতে পারল রাহাত। কীভাবে এদের হাত থেকে পালাবে, তা ভাবতে শুরু করল সে।

এফ ব্লকের নির্জন একটা গলিতে এসে ব্রেক কষল জিকো। কয়েক সেকেন্ড পর ঠিক পেছনেই এসে থামল অন্য বাইকটা। ওরাই নেমে দাঁড়াল আগে। তারপর প্রথমে নামল তপু। এরপর রাহাত। বাইকের আয়নায় নিজের চুলগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখে নিল জিকো। রাহাত দেখল, সামনে রাস্তা শেষ, খাড়া দেয়াল। দৌড় দিয়ে পালাতে হলে তপুর সামনে দিয়েই দৌড়াতে হবে। সুবিধা করতে পারবে না রাহাত। কারণ, তপুর পেছনেই আছে আরও দুজন। দৌড়ের চিন্তা বাদ দিল সে।

নির্মাণাধীন একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কত তলা বিল্ডিং এটা? ওপরে তাকাল রাহাত। ৮ তলা বোধ হয়—মনে মনে গুনল একবার। ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে সব ফ্লোরের। তারপর আর এগোয়নি কাজ। শেওলা পড়ে গেছে বিল্ডিংয়ের দেয়ালে। বেশ কিছু জায়গায় বড় বড় ঘাস, আগাছ। রাহাত একবার বন্ধুদের কাছে শুনেছিল, এ রকম একটা নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে আড্ডা মারে জিকোরা। এটাই বোধ হয় সেই বিল্ডিং।

বিল্ডিংয়ের সামনে ডেভেলপার কোম্পানির টিনের দরজায় তালা ঝুলছে। জং পড়া তালা দেখেই বোঝা যায়, অনেক দিন খোলা হয়নি এ বিল্ডিংয়ের দরজা। দরজার সঙ্গে লাগোয়া পিলারের ইটও ক্ষয়ে গেছে। ক্ষয়ে যাওয়া সেই ইট বেয়ে দেয়ালের ওপর উঠে পড়ল জিকো। তারপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে ‘ওরে নিয়ে আয়।’ বলেই লাফ দিয়ে নেমে গেল ওপাশে। বুঝতে দেরি হলো না রাহাতের। ওকেও যেতে হবে এই নির্মাণাধীন নির্জন বিল্ডিংয়ে।

‘শাবাশ! গুড বয়।’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল জিকো। ‘জাস্ট এটা শিওর হওয়ার জন্যই তোরে নিয়া আসছি, আর কিছু না। কিছু খাবি?’

দেয়ালে উঠে কিছুক্ষণ দাঁড়াল রাহাত। লাফ দিয়ে কোথায় নামতে হবে, তা দেখে নিল ওপর থেকে। একবার বসে ভাবল কিছুক্ষণ। নিচ থেকে তাড়া দিল তপু। ‘কিরে ফার্মের মুরগি, পকেটে হাত দিলি ক্যান? নামবি নাকি ধাক্কা দিমু আইসা?’ আবার উঠে দাঁড়াল রাহাত। জিকোর উদ্দেশে বলল, ‘জিকো ভাই, এই বিল্ডিংয়ে কেন এনেছেন আমাকে?’

‘নাম ব্যাটা।’

আরও পড়ুন

ঝুপ করে দেয়াল থেকে লাফিয়ে নেমে বলল রাহাত। ওর পরপরই দেয়ালে উঠে এল পেছনের বাইকে বসা বাকি দুজন। লাফিয়ে নিচে নামল ওরাও। সবার শেষে এসে নামল তপু। আকারে বিশাল সে, দেয়াল বেয়ে উঠতে কষ্টই হয়েছে ওর।

বিল্ডিংয়ের কাজে কোনো এক সময় কিছু টাইলস আনা হয়েছিল। সেগুলো পড়ে আছে ওভাবেই। টাইলসগুলোর ওপর বসে পা দোলাচ্ছিল জিকো। ‘দোস্ত, যা করবি কুইক কর।’ জিকোকে তাড়া দিল তপু।

‘এইখানে না। উপরে চল।’ ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে মাটিতে নামল জিকো। দুহাত দিয়ে প্যান্ট ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিল।

‘আবার উপরে ক্যান? সিঁড়ি দিয়া উঠা অনেক কষ্ট ব্যাটা।’

‘উপরে বাতাস ভরপুর। ভাল্লাগব। চল।’

দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। রাহাতও উঠল পেছন পেছন। রেলিং নেই সিঁড়িতে। পুরো বিল্ডিংয়ে একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। বেশ কয়েকটা বিড়াল চমকে ছুটে পালাল ওদের সাড়া পেয়ে। ঠিক কত তলায় এসে উঠেছে, বুঝতে পারল না রাহাত। ওর মনে হলো পাঁচতলা। একপাশে প্লাস্টিকের কয়েকটা চেয়ার আছে। বোঝা যায়, নিয়মিতই মানুষ আসে এখানে। একটা চেয়ার ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বসতে বলল জিকো। বসে পড়ল রাহাত। আরেকটা চেয়ার টেনে জিকো বসল রাহাতের ঠিক মুখোমুখি।

‘তোরে না স্কুলে আসতে মানা করলাম? তুই স্কুলে আসলি ক্যান?’ ঠান্ডা গলায় বলল জিকো।

‘আম্মু জোর করে পাঠাল। আমি আসতে চাই নাই।’ শান্ত থাকার চেষ্টা করল রাহাত।

‘কইসি না, একদম পিওর ফার্মের মুরগি এইটা।’ পাশ থেকে বলে উঠল তপু।

‘তুই নাকি জমির স্যারের সঙ্গে দেখা করসোস?’ রাহাতকে জিজ্ঞেস করল জিকো।

‘হ্যাঁ।’

‘ক্যান? কী বললি স্যারকে?’

‘কিছু না। টিফিনের পর ক্লাসে গিয়েছি। এটা বলতেই স্যারের কাছে গিয়েছিলাম।’

‘আমি যে ইভানের ব্যাগে ছুরি রাখসি, এটা বলিস নাই?’

‘না ভাই।’

‘ক্যান? বললি না ক্যান?’

‘আমি এই সব কিছু জানি না। দেখি নাই। আন্দাজে কী বলব?’

‘শাবাশ! গুড বয়।’ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল জিকো। ‘জাস্ট এটা শিওর হওয়ার জন্যই তোরে নিয়া আসছি, আর কিছু না। কিছু খাবি?’

‘না ভাই। আমি বাসায় যাব। অনেক দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই।’

‘তোরে আমি বাসায় দিয়া আসব। কোনো টেনশন নিস না। তুই জাস্ট আরেকটা কাজ কর। ফেসবুকে ঢোক।’

‘আমার ফেসবুক ডিঅ্যাকটিভ ভাই।’

‘অ্যাকটিভ কর। এটা তো ওয়ান-টুর ব্যাপার। ফেসবুকে ঢুইকা লাইভে যাবি। লাইভে গিয়া বলবি, ইভানের ব্যাগে ছুরিটা তুই রাখসোস। এই জন্য তুই খুবই দুঃখিত। ইভানের কাছে মাফ চাবি। কাজ শেষ।’

‘এটা কী বললেন ভাই!’

‘তাড়াতাড়ি, ফোন বাইর কর।’

খানিকটা সময় নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল রাহাত। ‘আমার এমবি নাই ভাই।’ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল সে।

আরও পড়ুন

‘আরে, আমরা তোরে হটস্পট দিচ্ছি। তুই রেডি হ। কী বলবি ঠিক কর। বলবি, তুই জাস্ট মজা করার জন্য ছুরিটা রাখসিলি। ঘটনা এত দূর যাবে, এটা তুই ভাবিস না। এখন খুব খারাপ লাগতেসে। কানতে পারবি? লাইভে আইসা কানলে জিনিসটা জমে।’

‘ওর কানের নিচে আগেই দুইটা বসায় দেই? তাইলে কানতে সুবিধা হইব।’ পাশ থেকে বলল তপু।

‘আরে না। ওর যে স্বাস্থ্য, তোর মাইর খাইলে আর অ্যালাইভ থাকবে না, লাইভ করবে কেমনে? কানেক্ট হইসে হটস্পট? দেখি, এদিক দে।’ ফোনটা কেড়ে নিল জিকো। ‘ওরে বাবা, অনেক বান্ধবী দেখি তোর। খুব চলতেসে তলেতলে, না?’

রাগে মুখ শক্ত হয়ে গেল রাহাতের। জিকো বলল,

‘তোরে বিশ্বাস নাই। ফোন আমার হাতে থাকবে। তুই লাইভ করবি। শুরু কর।’

‘ভাই, আমাকে কেন বিপদে ফেলছেন? আমি তো কাউকে কিছু বলি নাই। কোনো দিন বলব না।’

পাশ থেকে ছুটে গিয়ে রাহাতের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল তপু। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল রাহাতের।

‘এত কথা কিসের, বুঝলাম না। কর লাইভ। সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় যাইতে হবে না আমাদের? ভদ্রঘরের পোলাপান আমরা।’ বলল তপু।

‘আপনারা আমার লাইফ শেষ করে দিচ্ছেন। এটা অন্যায়।’

‘তোমরা কী করতে পারো, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অপেক্ষা করো। একটু পরই বুঝতে পারবে ব্যাপারটা কীভাবে সলভ হয়। এখন চুপচাপ চেয়ারে বসো।’

‘চুপ থাক।’ ধমক দিল জিকো। ‘আরে ব্যাটা, তোর কারণে আমার লাইফ শেষ হয়ে যাবে। সামনে আমার এইচএসসি। যে প্যাঁচ লাগসে, তাতে নিশ্চিত আমি টিসি খাব। পুলিশও ধরতে পারে আমারে। তখন পরীক্ষা দিব কোত্থেকে? তুই কষ্ট করে টিসিটা খা। অন্য স্কুলে ইজিলি ভর্তি হতে পারবি তুই। আমি সিস্টেম করে দিব। নে, এখন শুরু কর।’

‘আমি পারব না ভাই।’

‘পারবি না? ওই, ওরে ধর তো। পাঁচতলা থেইকা ফালায় দিব আজকে ওরে।’

আরও পড়ুন

তপুসহ জিকোর বাকি দুই বন্ধু এসে চেপে ধরল রাহাতকে। পাঁচতলার পেছন দিকে নিয়ে গেল ওকে। দেয়াল নেই বিল্ডিংয়ে। একবারে কোনায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল রাহাতকে। শক্ত করে ওকে ধরে রেখেছে ওরা, ছেড়ে দিলেই একেবারে নিচে পড়ে যাবে রাহাত। নিচের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল রাহাত। শিরশির করে উঠল পায়ের পাতা। এরা কি সত্যি সত্যি ফেলে দেবে ওকে? কী আশ্চর্য!

‘তুই লাইভ করবি?’ বলল জিকো।

‘করব ভাই, করব।’ নিচে তাকিয়ে বলল রাহাত।

‘আবার বল। করবি লাইভ?’

‘করব।’

‘ওই, ওরে নিয়া বসা।’

চেয়ার পর্যন্ত যেতে যেতে গোটা কয়েক কিল-ঘুষি পড়ল রাহাতের ঘাড়ে, পিঠে। চেয়ারে বসে হাঁপাতে থাকল রাহাত। ভয় কাটেনি এখনো। মুখের সামনে মোবাইল ধরল জিকো। ‘শুরু কর, চুলগুলা ঠিক কইরা নিস, আউলায় গেছে।’ ফোনের দিকে হাত বাড়াল রাহাত। হাত কাঁপছে ওর।

‘অ্যাই, কী হচ্ছে এখানে?’ পেছন থেকে বলে উঠল খুব পরিচিত একটা কণ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে পেছনে তাকাল ওরা। দ্রুত ছুটে এসে রাহাতকে জড়িয়ে ধরল আলভী। ‘তুই ঠিক আছিস দোস্ত?’ মাথা নাড়ল রাহাত। ঘুরে দেখল, শুধু আলভী আর রাজনই নয়, স্কুলের অনেকেই এসেছে। হাতে ব্যাট, স্ট্যাম্প। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং জমিরউদ্দিন স্যার। রাজনের হাতে মোবাইল, ভিডিও করছে সে।

‘স্যার আপনি!’ কোনোমতে বলল রাহাত।

‘হ্যাঁ, তুই ঠিক আছিস তো?’

‘জি স্যার।’

‘এর মধ্যে আপনার আসা ঠিক হয় নাই স্যার।’ রাগে ফোঁস ফোঁস করছে জিকো। কয়েকজন মিলে ধরে রেখেছে ওকে। ‘ব্যাপারটা আমরাই সলভ করতে পারতাম।’

‘তোমরা কী করতে পারো, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। অপেক্ষা করো। একটু পরই বুঝতে পারবে ব্যাপারটা কীভাবে সলভ হয়। এখন চুপচাপ চেয়ারে বসো।’

স্যারের চোখের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে রইল জিকো।

‘তাকিয়ে থেকো না। বসো।’ কড়া গলায় বললেন জমির স্যার। চেয়ার টেনে বসল জিকো। আচমকা দৌড় দিল জিকোর দুই বন্ধু। ‘ধর ধর’ করে চেঁচিয়ে উঠল সবাই। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে ওদের ফেলে পালিয়ে গেল জিকোর দুই বন্ধু। একটু পর বাইক স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শুনল রাহাত। পালিয়েছে ওরা।

‘তুই ফোন না ধরাতেই সন্দেহ হয়েছিল।’ রাহাতের কাঁধে হাত রেখে বলল আলভী। ‘বাইকটা যেভাবে যাচ্ছিল, খটকা লেগেছিল আমাদের। তোকে এতবার ফোন দিলাম, ধরলি না। তখনই স্কুলের সবাইকে জানালাম।’

‘আমরা যখন আসছি, তখন রাস্তায় জমির স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্যার ধরেই নিয়েছিলেন, মারামারি করতে যাচ্ছি আমরা। স্যারকে বিশ্বাসই করাতে পারিনি, উনি সঙ্গে চলে এসেছেন।’ বলল রাজন।

‘কিন্তু তুই কল করলি কী করে? এতজন মিলে ধরে রেখেছিল তোকে, ফোনের অ্যাকসেস পেলি কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল আলভী।

‘আপনি কেন কথা বলছেন স্যার?’ চেঁচিয়ে উঠল জিকো। ‘জুনিয়রদের এনে অপমান করছেন আমাকে? সব কটাকে দেখে নেব আমি।’

‘পুরো সময় আমাকে চোখে চোখে রেখেছিল ওরা। শুধু দেয়ালে উঠে একটু সময় পেয়েছি। দেরি করছিলাম ইচ্ছা করেই। তখনই একফাঁকে পকেটে হাত দিয়ে জাস্ট আন্দাজের ওপর টাচ করেছি ফোনে। আমি জানিও না ফোন গেছে কি না।’

‘গেছে। আমরা হ্যালো হ্যালো করছিলাম, কিছু শোনা যাচ্ছিল না, হঠাৎ তোর কণ্ঠ শুনলাম। জিকো, বিল্ডিং এসব কথা শুনেই সবাই বুঝে গিয়েছিল তুই কোথায় আছিস। আমরা জানি, এই পুরোনো বিল্ডিংয়েই জিকোর আস্তানা।’

সশব্দে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল জিকো। ‘আমি বাসায় যাব।’ বলে সামনে এগোতে চাইল সে। বাধা হয়ে দাঁড়াল ছেলেরা। একজনের বুকে ধাক্কা মারল জিকো। হই হই করে উঠে বাকিরা তেড়ে গেল জিকোর দিকে। ধমক দিয়ে সবাইকে শান্ত করলেন জমির স্যার। ঠেলে চেয়ারে বসালেন জিকোকে।

‘আপনি কেন কথা বলছেন স্যার?’ চেঁচিয়ে উঠল জিকো। ‘জুনিয়রদের এনে অপমান করছেন আমাকে? সব কটাকে দেখে নেব আমি।’

‘তার আগে তোমাকে কারা দেখতে আসে, দেখো।’ বললেন জমির স্যার।

শব্দ শুনল সবাই। গাড়ির ব্রেকের শব্দ। দ্রুত গাড়ি থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল ওরা। সামনে এগিয়ে গিয়ে নিচে তাকাল রাহাত। কাউকে দেখা গেল না। কিন্তু গাড়ি দেখে সে ঠিকই বুঝে গেল কারা এসেছে।

চলবে…

আরও পড়ুন
দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি
প্রচ্ছদ: আরাফাত করিম

আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619

আরও পড়ুন