ভূতের সঙ্গে অঙ্কের খেলা: সৈকতে সংখ্যার খেলা
অধ্যায় চার
‘কোথায় যে আমাকে টেনে নিয়ে আসো তুমি! এমন এক গুহা যার মুখ বন্ধ, এমন এক জঙ্গল যেখানে গাছের বদলে ১ আর আর্মচেয়ারের মতো মাশরুম। তা আজকে কোথায়? এখন আমি আছিটা কোথায়?’
‘সৈকতে। দেখে বুঝতে পারছ না?’
রোহান চারদিকে তাকাল। যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা বালি। সংখ্যার ভূত বসে আছে একটা ওল্টানো নৌকার ওপর। পেছনে সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জনমানুষের দেখা নেই।
‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি আজও ক্যালকুলেটর আনতে ভুলে গেছ,’ বলল ভূতটা।
‘তোমাকে আর কতবার বলতে হবে? আমি তো আর রাতে ঘুমানোর সময় আমার সব জিনিসপত্র নিয়ে শুতে পারি না। তুমি কি আগের রাতে জানতে পারো যে পরের রাতে কী স্বপ্ন দেখবে?’
‘অবশ্যই না,’ উত্তর দিল ভূতটা। ‘তবু, তুমি যদি আমার স্বপ্ন দেখতে পারো, তবে তোমার ক্যালকুলেটরের স্বপ্নও দেখতে পারো। কিন্তু না, আমাকেই জাদুর ভেলকি দেখিয়ে ওটা আনতে হবে! সব আমাকেই করে দিতে হবে! তারপর তুমি আবার অভিযোগ করবে, ওটা বেশি নরম, ওটা বেশি সবুজ বা বেশি চটচটে!’
‘কিছু না থাকার চেয়ে ওটাই ভালো ছিল।’
‘ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করছি,’ বলল ভূতটা। সে তার লাঠিটা ওপরে তোলার সঙ্গে সঙ্গে রোহানের চোখের সামনে একটা নতুন ক্যালকুলেটর হাজির হলো। আগেরটা যদি ব্যাঙের মতো হয়, তবে এবারেরটা দেখতে নরম, লোমশ বিছানা বা সোফার মতো। আর সাইজেও বিশাল। ক্যালকুলেটরের কীবোর্ডটা পশমে ঢাকা এবং ছোট। কিন্তু সংখ্যার স্ক্রিনটা অনেক বড়। ভারি অদ্ভুত এক ক্যালকুলেটর।
‘এবার ১-কে তিন দিয়ে ভাগ করো,’ ভূতটা হুকুম দিল, ‘আর দেখো কী পাও।’
১ ÷ ৩
রোহান বোতাম টিপল। সেই বিশাল লম্বা স্ক্রিনে সবুজ রঙে উত্তর উঠল:
০.৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩৩
‘এটা কি কখনো থামবে না?’ জিজ্ঞেস করল রোহান।
‘অবশ্যই থামবে,’ উত্তর দিল ভূতট। ‘যেখানে স্ক্রিন শেষ হবে সেখানে।’
‘তারপর কী?’
‘তারপর এটা চলতেই থাকবে। তুমি শুধু দেখতে পাবে না।’
‘কিন্তু এটা তো সবসময় একই, একটার পর একটা তিন। কী বোরিং!’ ‘ঠিক।’
‘বোকাও বলতে পারো! তার চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ লেখা অনেক সহজ:
তাহলে আমাকে আর ওই তিনের লম্বা লাইন নিয়ে ভাবতে হয় না।’
‘সত্যি,’ বলল ভূতটা, ‘কিন্তু তখন তোমাকে ভগ্নাংশ নিয়ে কাজ করতে হবে। আর আমি যদি ভুল না করি, তুমি ভগ্নাংশ একদম সহ্য করতে পারো না। ধরো, ৩৩ জন রুটিওয়ালার অর্ধেক জন আড়াই ঘণ্টায় ৮৯টা রুটি বানাতে পারে। তাহলে ৫৩/৪ জন রুটিওয়ালা দেড় ঘণ্টায় কতগুলো রুটি বানাতে পারবে?’
‘না! না! ওসব বাদে যা খুশি দাও! আমাকে দশমিক দাও! এমনকি সংখ্যা যদি কখনো শেষ নাও হয়, তবুও আমাকে দশমিক দাও। আমি শুধু জানতে চাই, ওসব তিন ওখানে কী করছে।’
‘সহজ। দশমিকের বিন্দুর পর প্রথম তিন মানে হলো তিন-দশমাংশ বা দশ ভাগের তিন ভাগ। দ্বিতীয়টা মানে তিন-শতাংশ বা একশ ভাগের তিন ভাগ, তৃতীয়টা এক হাজার ভাগের তিন ভাগ, এবং এভাবে চলতে থাকবে। তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।
০.৩
০.০৩
০.০০৩
০.০০০৩
…….
বুঝলে? ভালো। এবার সবগুলোকে তিন দিয়ে গুণ করার চেষ্টা করো। ওই তিন, তিন-দশমাংশ, তিন-শতাংশ এবং বাকি সব।’
‘সমস্যা নেই,’ বলল রোহান। ‘আমি এটা মনে মনেই করতে পারব।’
০.৩ × ৩ = ০.৯
০.০৩ × ৩ = ০.০৯
০.০০৩ × ৩ = ০.০০৯
০.০০০৩ × ৩ = ০.০০০৯
‘ভালো। এখন যদি সবগুলো নয় একসঙ্গে যোগ করো, তাহলে কী হবে?’ ‘দেখা যাক। ০.৯ + ০.০৯ = ০.৯৯ এবং ০.৯৯ + ০.০০৯ = ০.৯৯৯। প্রত্যেক লাইনে ৯। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এটা অনন্তকাল চলতে থাকবে।’
‘একদম ঠিক ধরেছ। যদিও একটু ভাবলেই তুমি দেখবে, এখানে একটা ঘাপলা আছে। ১/৩ + ১/৩ + ১/৩ = ১, তাই না? কারণ এক-তৃতীয়াংশকে তিন দিয়ে গুণ করলে ১ হয়। সবসময় হয়েছে এবং সবসময় হবে। তাহলে? কী মনে হয় তোমার?’
‘আমি জানি না,’ বলল রোহান। ‘এখনো কিছু একটা কম আছে—০.৯৯৯ সংখ্যাটা ১-এর খুব কাছাকাছি, কিন্তু পুরোপুরি ১ নয়।’
‘এটাই তো আসল পয়েন্ট। এজন্যই তোমাকে নয়গুলো চালিয়ে যেতে হবে এবং কখনো থামা যাবে না।’
‘বলা সহজ কিন্তু করা কঠিন।’
‘সংখ্যার ভূতের জন্য নয়।’ আবারও মিটিমিটি হেসে সে তার লাঠি ঘোরাল। চোখের পলকে আকাশটা ভরে গেল বেগুনি রঙের অসীম সংখ্যক নয়ে, যা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ওপর থেকে আরও ওপরে উঠে যাচ্ছে।
‘থামো!’ চেঁচিয়ে উঠল রোহান। ‘দয়া করে থামো! আমার বমি পাচ্ছে।’ ‘এক তুড়িতেই সব গায়েব করে দেব। কিন্তু তার আগে তোমাকে মানতে হবে, শূন্যের পেছনের ওই নয়ের শিকল যদি অনন্তকাল ধরে চলে, তবে তা ১-এর সমান হবে।’
ইতিমধ্যে নয়ের শিকল বড় হতে হতে আকাশটা নয়ের ভিড়ে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল। রোহানের এখন মাথা ঘুরছে, বমি বমি লাগছে, কিন্তু সে হার মানতে নারাজ।
‘কক্ষনো না!’ আবার চেঁচিয়ে উঠল রোহান। ‘তুমি শিকলে যত খুশি নয় যোগ করো, সবসময় কিছুটা কম থাকবে। আর সেটা হলো শেষ নয়টা।’
‘শেষ নয় বলে কিছু নেই!’ ভূতটা রাগে চিৎকার করে উঠল। রোহান এখন আর ভূতের রাগ দেখে ভড়কে যায় না। এতক্ষণে সে বুঝে গেছে, যখনই ভূতটা রেগে যায়, তখনই মজার কিছু একটা ঘটে। এমন কিছু যা ভূতটা সহজে বোঝাতে পারে না। কিন্তু শিকলটা রোহানের মাথার খুব কাছে ঝাপটাচ্ছিল এবং ভূতটাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরেছিল যে তার অনেকটা অংশ আর দেখাই যাচ্ছিল না।
‘ঠিক আছে,’ বলল রোহান। ‘আমি মানলাম। কিন্তু শর্ত হলো তোমাকে ওই নয়গুলো সরাতে হবে।’
‘এতক্ষণে লাইনে এলে,’ বলল ভূতটা। সে তার লাঠি তুলল। লাঠিতে এখনো কয়েকটা ৯ জড়িয়ে আছে। তারপর সে বিড়বিড় করে কিছু একটা মন্ত্র পড়ল আর চোখের পলকে শিকলগুলো উধাও হয়ে গেল।
‘উফ! বাঁচলাম,’ বলল রোহান। ‘এটা কি শুধু তিন আর নয়ের বেলায় ঘটে, নাকি অন্য সংখ্যাও এমন ভয়ংকর শিকল বানাতে পারে?’
‘সাগরের বালুকণার মতোই অসীম সব শিকল আছে। তোমার কী মনে হয়, ০.০ আর ১.০-এর মাঝখানে কয়টা সংখ্যা আছে?’
রোহান অনেকক্ষণ ভাবল। ‘অসীম সংখ্যা। এক এবং অনন্তকালের মাঝখানে যতগুলো আছে ততগুলো।’
‘মন্দ না,’ বলল ভূতটা। ‘আসলে বেশ ভালো। কিন্তু তুমি কি এটা প্রমাণ করতে পারবে?’
‘পারব।’
‘দেখাও আমাকে।’
‘আমাকে শুধু একটা শূন্য আর একটা বিন্দু লিখতে হবে,’ বলল রোহান। ‘আর বিন্দুর পরে একটা এক: ০.১। তারপর ওটার পর একটা দুই। আর এভাবে চলতেই থাকবে। আমি যদি চালিয়ে যাই, তবে ০.২-এ পৌঁছানোর আগেই এখন পর্যন্ত লেখা সব সংখ্যা আমি বিন্দুর পরে বসিয়ে দিতে পারব।’
‘সব পূর্ণ সংখ্যা।’
‘অবশ্যই। সব পূর্ণ সংখ্যা। এক এবং অসীমের মাঝখানের প্রতিটি সংখ্যার আগে একটা শূন্য আর একটা বিন্দু বসানো যায়, আর তার প্রতিটিই ১-এর চেয়ে ছোট।’
‘চমৎকার, রোহান। আমি তোমাকে নিয়ে গর্বিত।’
কিন্তু গর্বিত হলেও সে এত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। তার মাথায় নতুন একটা বুদ্ধি এল।
‘বিন্দুর পরে তোমার ওই অসীম সংখ্যার নিজস্ব একটা জীবন আছে। আমি কী বোঝাতে চাইছি, তুমি কি দেখতে চাও?’
‘হ্যাঁ! নিশ্চয়ই’ বলল রোহান। ‘তবে শর্ত হলো সৈকতটা যেন বিখ্যাত সংখ্যা দিয়ে ভরে না যায়।’
‘চিন্তা কোরো না। তোমার ওই বড় ক্যালকুলেটরই সব সামলাবে। তোমাকে শুধু সাতকে এগারো দিয়ে ভাগ করতে হবে।’
রোহানকে দ্বিতীয়বার বলতে হলো না। সে বোতাম টিপল।
৭ ÷ ১১ = ০.৬৩৬৩৬৩৬৩৬৩৬৩৬৩৬৩৬...
‘আরে, এ কী? সব তেষট্টি। আবার বাজি ধরে বলতে পারি, এটা অনন্তকাল চলতে থাকবে।’
‘বাজি তুমি জিতেছ। কিন্তু এটা কিছুই না। ছয়কে সাত দিয়ে ভাগ করার চেষ্টা করো।’
রোহান টিপল:
৬ ÷ ৭ = ০.৮৫৭১৪২৮৫৭১৪২৮৫৭...
‘একই সংখ্যা বারবার ফিরে আসছে!’ সে চিৎকার করে উঠল। ‘৮৫৭১৪২ বারবার আসছে। মনে হচ্ছে যেন গোল হয়ে ঘুরছে!’
‘সংখ্যাগুলো সত্যিই দারুণ সব জীব! আসলে সাধারণ সংখ্যা বলে কিছু নেই। প্রত্যেকটার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, নিজস্ব গোপন রহস্য আছে। তুমি কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারবে না ওদের ভেতরে কী চলছে। যেমন ধরো, শূন্যের পরের ওই নয়ের শিকল—এতগুলো নয়, তবুও পুরোপুরি ১ হয় না। আর এমন আরও অনেক সংখ্যা আছে, যেগুলো আরও খারাপ আচরণ করে। সেগুলো শূন্যের পর একদম পাগল হয়ে যায়। এদের বলা হয় অযৌক্তিক সংখ্যা। এরা কোনো নিয়ম মেনে চলতে চায় না বলে এমন নাম হয়েছে। তোমার হাতে যদি একটু সময় থাকে, তাহলে আমি আনন্দের সঙ্গে তা দেখাতে পারি।’
রোহান এতদিনে বুঝে গেছে, সংখ্যার ভূত যখন গায়ে পড়ে ভদ্রতা দেখায়, তখন কপালে কিছু একটা আছে। কিন্তু তার কৌতূহল এত বেশি যে সে না করতে পারল না।
‘ঠিক আছে,’ বলল রোহান। ‘দয়া করে দেখাও।’
‘আমাদের সেই লাফানোর খেলাটা নিশ্চয়ই মনে আছে। আমরা দুই, পাঁচ আর দশ দিয়ে যা করেছিলাম। দশ গুণ দশ গুণ দশ সমান এক হাজার। আগে আমরা এভাবে লিখেছিলাম:
১০৩ = ১০০০
কারণ এতে সময় কম লাগে।’
‘ঠিক। আর দুই দিয়ে লাফালে বা পাওয়ার করলে আমরা পাই:
২, ৪, ৮, ১৬, ৩২…
এভাবে চলতেই থাকবে। তোমার ভাষায় অনন্তকাল পর্যন্ত।’
‘বেশ,’ ভূতটা বলল, ‘তাহলে বলো তো, দুইয়ের ওপর চার মানে কত?’
‘১৬! বেশ ভালোই পারি, তাই না?’
‘দারুণ! এবার চলো প্রথম পাওয়ারটা উল্টো করে দিই। মানে উল্টো দিকে লাফানো। তবে এভাবে পেছনে গেলে তা লাফানো হয় না। আমরা এই ধাপটাকে বলি ‘শালগম তোলা’। মাটি থেকে আমরা যেমন সুন্দর সবজি তুলে আনি, এই উল্টোদিকের পাওয়ার তেমন।’
‘দুই।’
‘হ্যাঁ! শালগম তোলা হলো আমাদের প্রথম লাফের উল্টো। তাই ১০০-এর শালগম হলো দশ, আর দশ হাজারের শালগম একশ। পঁচিশের শালগম কত?’
‘পঁচিশের,’ বলল রোহান, ‘পচিশ মানে পাঁচ গুণ পাঁচ, তার মানে, এর শালগম পাঁচ।’
‘চালিয়ে যাও রোহান, একদিন তুমি আমার সহকারী হবে। ছত্রিশের শালগম?’
‘ছত্রিশের শালগম হলো ছয়।’
‘৫৯২৯-এর শালগম?’
‘তুমি কি পাগল নাকি?’ রোহান চেঁচিয়ে উঠল। ‘তুমি কি আশা করো আমি ওটা পারব? মিস্টার বাকেরের স্কুলেই যথেষ্ট পচা অঙ্ক দিয়ে আমাদের জ্বালায়। স্বপ্নে আর ওসব দরকার নেই।’
‘শান্ত হও, শান্ত হও,’ বলল ভূতটা। ‘ওরকম ছোটখাটো সমস্যার জন্যই তো পকেট ক্যালকুলেটর বানানো হয়েছে।’
‘পকেট ক্যালকুলেটর! ওই জিনিস তো একটা সোফার সমান বড়।’
‘যা-ই হোক, তুমি খেয়াল করলে দেখবে ওটাতে একটা বোতাম আছে যাতে এই চিহ্নটা আঁকা:
√
এর মানে কী?
‘শালগম!’
‘ঠিক। এবার চেষ্টা করো।’
√৫৯২৯ = কত?
রোহানকে যা বলা হলো তাই করল, আর সঙ্গে সঙ্গে সোফা-ক্যালকুলেটরের স্ক্রিনে ভেসে উঠল: ৭৭।
‘ভালো। এবার শক্ত হয়ে বসো আর দুই-এর শালগম বের করার চেষ্টা করো।’
রোহান আবারও তাই করল, আর উত্তর পেল:
১.৪১৪২১৩৫৬২৩৭৩০৯৫০৪৮৮০১৬৮৮৭২৪...
‘ধুর ছাই!’ সে চিৎকার করে উঠল। ‘এ তো জগাখিচুড়ি! সংখ্যার জঞ্জাল। আমি এর আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘অন্য কেউও পারে না, বাছা। এটাই তো আসল ব্যাপার। দুইয়ের শালগম একটা অযৌক্তিক সংখ্যা।’
‘এটা কীভাবে এগোচ্ছে তা জানার কি কোনো উপায় আছে? কারণ আমার মনে হচ্ছে এটা এগোচ্ছে।’
‘একদম ঠিক, কিন্তু আমি এখানে তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। সংখ্যাটাকে আরও এগিয়ে নিতে গেলে আমি বা আমার ক্যালকুলেটর অকেজো হয়ে যাব।’
‘ভয়ংকর!’ বলল রোহান। ‘সত্যিই একটা দানব সংখ্যা। কিন্তু এটাকে এভাবে লেখো:
√২
তাহলে মনে হবে ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না।’
‘আচ্ছা, চলো একটু কম ভয়ের কিছু চেষ্টা করি।’ সে বালুর ওপর কয়েকটা ছবি আঁকল আর বলল, ‘এগুলোর দিকে তাকাও। বর্গক্ষেত্র বা স্কয়ারের ভেতরের ছোট বাক্সগুলো গুনবে আর আমাকে বলবে তুমি বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছ কি না।’
১ × ১ = ১২ = ১
২ × ২ = ২২ = ৪
৩ × ৩ = ৩২ = ৯
৪ × ৪ = ৪২ = ১৬
‘হুম, দেখতে পাচ্ছি। এগুলো সব লাফানো সংখ্যা।’
‘ঠিক। কীভাবে কাজ করে বুঝতে পারছ তো? প্রতিটা বর্গ বা স্কয়ারের এক পাশের বাক্সগুলো গুনলে তুমি সেই সংখ্যাটা পাবে যা দিয়ে লাফাতে হবে। আর উল্টোটাও সত্যি। তুমি যদি জানো, স্কয়ারে মোট কয়টা বাক্স আছে, তবে তুমি এক পাশের বাক্সের সংখ্যা পেয়ে যাবে। যেমন:
√১ = ১, √৪ = ২, √৯ = ৩, √১৬ = ৪
‘দারুণ,’ বলল রোহান, ‘কিন্তু এর সঙ্গে অযৌক্তিক সংখ্যার সম্পর্ক কী?’
‘আসলে, স্কয়ার বা বর্গক্ষেত্রগুলো খুব ধূর্ত প্রাণী। কখনো স্কয়ারকে বিশ্বাস করবে না। ওদের দেখতে খুব নিরীহ মনে হয়, কিন্তু ওরা অনেক ফন্দি জানে। যেমন ধরো এটা।’
সে বালুর ওপর একটা সাধারণ বর্গ বা স্কয়ার আঁকল। তারপর পকেট থেকে একটা লাল স্কেল বের করে কোণাকুণিভাবে ওটার ওপর রেখে বলল, ‘এখন যদি প্রতিটা বাহুর দৈর্ঘ্য হয় এক...’
‘এক কী? এক ইঞ্চি নাকি এক ফুট?’ রোহান মাঝখানে বাধা দিল।
‘তাতে কিছু আসে যায় না,’ ভূতটা অধৈর্য হয়ে বলল। ‘এক যা খুশি তাই। ওটাকে যা ইচ্ছা ডাকো। এখন বলো লাল লাইনটা কত লম্বা।’
‘আমি কীভাবে জানব?’
‘দুই-এর শালগম!’ ভূতটা বিজয়ের সুরে চিৎকার করে বলল।
‘তুমি ওটা পেলে কীভাবে?’ জিজ্ঞেস করল রোহান।
সে আবার হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে।
‘চিন্তা কোরো না,’ বলল ভূতটা। ‘আমরা ওখানেই আসছি। আমাদের শুধু ওটার ওপর কোণ করে আরেকটা স্কয়ার বসাতে হবে।’
সে পকেট থেকে আরও পাঁচটা স্কেল বের করে বালুর ওপর রাখল। ফলে ছবিটা দেখাল এমন:
‘এখন অনুমান করো বলো, কালোটার ওপর কোণ করা লাল স্কয়ারটা কত বড়?
‘আমার কোনো ধারণা নেই।’
‘লাল স্কয়ারটা কালোটার ঠিক দ্বিগুণ বড়। কালোটার নিচের অর্ধেকটা লালটার চার কোণের এক কোণায় সরিয়ে নাও, তাহলেই বুঝবে।’
‘এটা আমাকে ছোটবেলার একটা খেলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে,’ বলল রোহান। ‘আমরা বলতাম হ্যাভেন অ্যান্ড হেল বা স্বর্গ-নরক খেলা। আমরা একটা কাগজ ভাঁজ করতাম যার কিছু অংশ লাল আর কিছু অংশ কালো থাকত। কালো খুললে স্বর্গে, আর লাল খুললে নরকে।’
‘আর তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, এখানে কালোর চেয়ে লাল দ্বিগুণ বেশি?’
‘পাচ্ছি।’
‘ভালো। এখন, যেহেতু কালো স্কয়ারের ক্ষেত্রফল এক গুণ এক কুয়াং’
‘কুয়াং কী?’ জিজ্ঞেস করল রোহান।
‘আমরা প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্যকে কুয়াং ডাকব!’ যাহোক, আমরা এটাকে লিখতে পারি ১২। আর যদি লাল স্কয়ারটা কালোটার দ্বিগুণ হয়, তবে এর ক্ষেত্রফল কত হবে?’
‘দ্বিগুণ, মানে ১২,’ বলল রোহান। ‘অন্যভাবে বললে দুই।’
‘ঠিক। তাহলে লাল স্কয়ারের প্রতি বাহু কত লম্বা? আমি তোমাকে একটা সূত্র দিচ্ছি। সূত্রটা হলো, শুধু একটা উল্টো লাফ দরকার।’
‘বুঝেছি!’ রোহানের চোখ খুলে গেল। ‘শালগম! তোমাকে দুইয়ের শালগম নিতে হবে!’
‘হ্যাঁ। আর এর মাধ্যমে আমরা আবার ফিরে এলাম সেই অযৌক্তিক সংখ্যায়। ১.৪১৪২১৩...।’
‘থামো! থামো!’ তাড়াতাড়ি বলল রোহান। ‘তুমি যদি ওই সংখ্যাটা নিয়ে বকবক করতে থাকো তবে আমি পাগল হয়ে যাব।’
‘এটা অতটাও খারাপ না,’ বলল ভূতটা। ‘কিন্তু আমাদের ওটা বের করার দরকার নেই। তবে ভেবো না যে অযৌক্তিক সংখ্যা খুব বেশি নেই। বরং উল্টো। আমার কথা বিশ্বাস করো, সৈকতের বালুর মতো এগুলো ছড়িয়ে আছে প্রচুর, অন্যগুলোর চেয়েও অনেক বেশি।’
‘কিন্তু অন্যগুলোর পরিমাণও তো অসীম, সেই সাধারণ সংখ্যাগুলো। অন্তত তুমি তো সেটাই বলে আসছ। বলেই যাচ্ছ আর বলেই যাচ্ছ।’
‘কারণ ওটা সত্য। বিশ্বাস করো! শুধু অযৌক্তিক সংখ্যার পরিমাণ আরও, আরও অনেক বেশি।’
‘কীসের চেয়ে বেশি? অসীমের চেয়েও বেশি?’
‘ঠিক তাই।’
‘এবার তুমি বাড়াবাড়ি করছ,’ কড়া গলায় বলল রোহান। ‘আমি এটা বিশ্বাস করি না। অসীমের চেয়ে বেশি? অসীমের চেয়ে বেশি কিছু হয় কীভাবে? এসব গাঁজাখুরি গপ্পো, আর কিছু না।’
‘প্রমাণ চাও?’ জিজ্ঞেস করল ভূতটা। ‘তুমি কি চাও আমি ম্যাজিক করে সব অযৌক্তিক সংখ্যাকে একসঙ্গে হাজির করি?’
‘না, ওটা বাদে যা খুশি করো! নয়ের শিকলটাই যথেষ্ট ছিল। তাছাড়া জাদু দিয়ে কি আর কোনো কিছু প্রমাণ হয়?’
‘ধুর!’ বলল ভূতটা। ‘তুমি আমাকে ধরে ফেলেছ!’
কিন্তু ভূতটাকে খুব একটা বিরক্ত মনে হলো না। সে শুধু কপালে ভাঁজ ফেলে গভীর চিন্তায় মগ্ন হলো।
‘আমি হয়তো আরেকটা প্রমাণ দিতে পারব,’ শেষমেশ বলল সে, ‘কিন্তু যদি তুমি জোর করো তবেই।’
‘না, ধন্যবাদ,’ বলল রোহান। ‘আজকের মতো যথেষ্ট হয়েছে। আমি ক্লান্ত। যদি ঠিকঠাক না ঘুমাই, তবে কাল স্কুলে খবর আছে। আমি বরং তোমার ক্যালকুলেটরের ওপর একটু গা এলিয়ে দিই। তুমি যদি কিছু মনে না করো আরকি। ওটা দেখতে বেশ আরামদায়ক লাগছে।’
‘অবশ্যই,’ বলল ভূতটা। রোহান সেই পশমি, লোমশ, সোফার মতো ক্যালকুলেটরের ওপর শুয়ে পড়ল।
‘তুমি তো ঘুমিয়েই আছো। ঘুমের মধ্যেই তুমি সবচেয়ে ভালো শেখো।’ ভূতটা পা টিপে টিপে সরে গেল যাতে রোহানের ঘুম না ভাঙে।
লোকটা আসলে অতটাও খারাপ না, ভাবল রোহান। সত্যি বলতে, ও বেশ ভালো। রোহান শান্তিতে, স্বপ্নহীনভাবে পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাল। সে পুরোপুরি ভুলেই গিয়েছিল যে পরদিন শনিবার, আর শনিবারে তো স্কুল বন্ধ!
হান্স ম্যাগনুস এনজেন্সবার্গারের ডের সালেন-টয়ফেল অবলম্বনে