‘ইভান ছেলেটা তো বেশ অদ্ভুত!’ মনে মনে বলল রুশা। চাওয়ামাত্র বিড়ালটা পেয়ে যাবে তা ও কল্পনাও করেনি। ফেসবুকে পোস্ট দেখে হুট করেই আইডিয়াটা এসেছিল মাথায়। একটা বিড়াল তো নেওয়াই যায়। এই বাসায় আসার পর থেকেই একেবারে বন্ধুহীন দিন পার করছে রুশা। এখনো কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেনি। স্কুল থেকে ফেরার পর একাই থাকতে হয় ওকে। বিড়ালটা থাকলে কিছুটা সময় কাটবে। ‘কী নাম রাখা যায় বিড়ালটার? বারান্দার দরজা খুলে রাখা যাবে না। যদি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একলাফে নিচে চলে যায়? ঝর্ণা খালাকে বলে দিতে হবে প্রতিদিন যেন মাছ রান্না করে। আমি তো শিং মাছ খাই না। মাগুর মাছও না। বিড়াল কি সব মাছ খায়?’ একের পর এক ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে রুশার মাথায়। হঠাৎ বেজে ওঠা কলবেল চমকে দিল ওকে। নিশ্চয়ই বাবা এসেছেন। ঘর থেকে ছুটে দরজার দিকে গেল রুশা। বিড়ালের খবরটা বলে সারপ্রাইজ দিতে চায় বাবাকে। দরজার কাছে এসে ‘বাবা’ বলে ডেকেই থেমে যেতে হলো ওকে। ফোনে কথা বলছেন বাবা। হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, ‘জরুরি’। কিছুক্ষণ অপেক্ষায় থেকে শেষমেশ মন খারাপ করে নিজের ঘরে ফিরে এল রুশা।
শেষ কবে বাবার সঙ্গে ভালোভাবে কথা হয়েছে মনে পড়ে না রুশার। পড়ার টেবিলে বসে বই-খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করল ও। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। হাতে তুলে নিল ফোনটা। ফেসবুকে ঢুকে স্ক্রল করল কিছুক্ষণ। ইদানীং অদ্ভুত অদ্ভুত সব সাজেস্টেড পোস্ট আসে হোম পেজে। আবার ফ্রেন্ডরাও এমনভাবে ঢঙের গ্যালন ঢেলে দেয় যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায় রুশার। এই যেমন ওদের ক্লাসের একটা মেয়ে তার এক বান্ধবীর ছবি দিয়ে অনেক ভালো ভালো কথা লিখেছে ফেসবুকে। অথচ সারা দিন ওই বান্ধবীর নামে বিচিং করে মেয়েটা। স্ক্রল করে পোস্টটা এড়িয়ে গেল রুশা। ও খেয়াল করেছে, রাত হলেই মেসেঞ্জার গ্রুপগুলোয় একের পর এক মেসেজ আসতে শুরু করে। অনেক সময় গ্রুপে ঢুকে রুশা বুঝতেই পারে না কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কী একটা ইস্যু নিয়ে সবাই কথা বলছে আজকেও, ধরতে পারল না ও। কনটেকসট কী তা জানতেও ইচ্ছা করল না। কিছু একটা ঘটলেই সেটা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হবে? বিরক্তিকর। ইনস্টাগ্রামে ঢুঁ মারল ও। অনেক দিন স্টোরিতে কোনো ছবি আপলোড করা হয় না। নিজের একটা ছবি তুলে আপলোড করে দেবে নাকি? থাক, কী দরকার…ওপাশ থেকে দরজায় টোকা দিলেন বাবা। নড়েচড়ে বসল রুশা।
‘কী অবস্থা, মা?’ চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ালেন বাবা। হাত রাখলেন মেয়ের মাথায়।
‘এই তো।’ কোনোমতে বলল রুশা।
‘কোচিংয়ে গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার মা ফোন করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভাত খেয়েছ?’
‘না।’
‘খেতে বসি, চলো।’
‘যাও, আমি আসছি।’
‘ওকে। তাড়াতাড়ি আসো।’
বাবা চলে যাওয়ামাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুশা। ইদানীং মনে হয়, বাবা নয়, ভাইভা পরীক্ষার পরীক্ষকের সঙ্গে কথা হয় তার। কোনো কথা নেই, শুধু প্রশ্ন। ‘স্কুলে গিয়েছিলে? খেয়েছ? শরীর ভালো? টাকা লাগবে? পরীক্ষা কবে? পড়াশোনা চলছে ঠিকঠাক?’ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই এক শব্দে দিয়ে দেওয়া সম্ভব। ভাবটা এমন, যেন মা-বাবার কাজই শুধু আপডেট নেওয়া। ‘উইন্ডোজ ইলেভেনও তো এতবার আপডেট নেয় না।’ বিরক্ত হয়ে ভাবল রুশা। ও কথা বলতে চায়। অনেক কথা। এত বড় একটা বাসায় ও কি দেয়ালের সঙ্গে কথা বলবে? এমন সময় আবারও টোকা পড়ল দরজায়। ঝর্ণা খালা এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার সামনে। অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন এ বাসায়। রুশাকে দেখাশোনা করাই তাঁর কাজ। খালা বললেন,
‘স্যারের ফোন আইসে। দেরি হইব। তুমি খাইয়া ওঠো।’
‘আমি ভাত খাব। না।’
‘এমন কথা কয় না। রাইতে ভাত না খাইলে এক চড়ুই সমান গোশত কইমা যায় শরীল থেইকা।’
‘তুমি কি চড়ুই পাখি ধরে ধরে মেপে দেখেছ?’
‘কী যে কও, বুঝি না।’
‘সবার জন্যই কি চড়ুই সমান গোশত কমে? নাকি কারও জন্য চড়ুই, কারও জন্য কাক?’
‘ধুরো জ্বালা। কী কও উল্টাপাল্টা? খাইবা চলো।’
‘আমার খাবারটা এখানে দিয়ে যাও। এত বড় টেবিলে একা বসে খেতে ভালো লাগে না। একা খেলেও এক চড়ুই সমান গোশত কমে যায়।’
‘আল্লাহ গো আল্লাহ! কী যে কয় এই মাইয়া! আমি পেলেট দিয়া যাইতাসি।’
‘আচ্ছা শোনো, আমার একটা বাক্স লাগবে। কার্টন টাইপ বাক্স আছে না? আম এনেছিল যে বাক্সে, ওই রকম।’
‘বাক্স দিয়া কী করবা?’
‘ভেতরে ঢুকে বসে থাকব। এত প্রশ্ন করো কেন? বাক্স আনতে বলেছি, নিয়ে আসবা।’
‘ঠিক আছে। আইনা রাখমু।’
ভাত নিয়ে আসতে গেল খালা। ‘স্কুল থেকে ফেরার সময় বিড়ালটা নিয়ে আসব।’ মনে মনে প্ল্যান করে ফেলল রুশা। খালা এসে পড়ার টেবিলে ভাত দিয়ে গেল প্লেটে। তখনই ওর মনে হলো বিড়ালের জন্যও একটা প্লেট কিনতে হবে। আর পানি খাওয়ার জন্য একটা বাটি। ফোন হাতে নিয়ে ইউটিউবে ঢুকল রুশা। বিড়ালকে কীভাবে ট্রেইন করতে হয়, তা নিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করল ভাত খেতে খেতেই৷ খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসল আবার। বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। উঠে গিয়ে পাশের জানালা খুলে দিল। জানালা খুলতেই বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাস ঝাপটা দিল মুখে। রুশার মনে হলো এতক্ষণ ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছিল বাতাসটা। বন্ধ জানালাটা আটকে দিচ্ছিল বাতাসটাকে। জানালা খুলতেই একেবারে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে বাতাস। এক নিমেষেই পুরো ঘর ঠান্ডা। বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ এসে লাগল ওর নাকে। রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত এক কাপ চা বানিয়ে আনল রুশা। গান শুনতে ইচ্ছা করছে। চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা তুলে গান শুনতে শুরু করল ও। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোয় বৃষ্টির ছাঁট। একটা গানের শেষ আর আরেকটা গানের শুরুর মাঝখানের বিরতিতে শোনা যাচ্ছে মেঘ ডাকার গমগম শব্দ। ভালোই লাগছিল রুশার। হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনাটার কথা। যে ঘটনার কথা এখনো কাউকে বলেনি ও। রুশার মনে হলো চারপাশ থেকে ওর দিকে চেপে আসছে ঘরের দেয়ালগুলো। দম আটকে আসছে রুশার। হেডফোন খুলে ফেলল ও। টেবিল চেয়ার ছেড়ে ছুটে গেল বারান্দায়। ঠান্ডা বাতাসে নিশ্বাস নিল বুক ভরে। এত বছর পরও সেই ঘটনার ট্রমা কাটেনি ওর৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুশা। আজ রাতে বোধ হয় আর ঘুম হবে না ওর।
*
ফুফার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল ইভানের। রীতিমতো লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল ও। কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ধাতস্থ হতে। ফুফা কেন চিৎকার করছেন ঠিক বোঝা গেল না। হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল ইভানের শরীরে। লাফ দিয়ে নামল বিছানা থেকে। হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে তাকাল খাটের নিচে—বিড়ালটা নেই৷ দ্রুত উঠে দাঁড়াল ইভান। গত রাতে দরজাটা লাগানো হয়নি ভালোভাবে। দমকা বাতাসে খুলে গেছে। সেখান দিয়েই বেরিয়ে গেছে বিড়ালটা। ফুফার চিৎকারের কারণটা হাড়ে হাড়ে বুঝে ফেলল ইভান। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এল ও। ডাইনিং রুমে ফুফা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ঠিক সামনে বিড়ালছানাটা এমনভাবে হাঁটাহাঁটি করছে যেন এটা তারই বাসার বারান্দা, ফুফা হলেন কেয়ারটেকার। ইভানকে দেখেই ধমকে উঠলেন ফুফা।
‘ইভান, এটা কী?’
‘বিড়ালের বাচ্চা।’ শান্ত থাকার চেষ্টা করল ইভান।
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার বাসায় বিড়াল ঢুকল কী করে? তুমি জানো না কুকুর বিড়াল আমি পছন্দ করি না?’
‘জানি।’
‘এক্ষণ এটাকে ফেলে দিয়ে আসো। বিড়াল থেকে কত রোগজীবাণু ছড়ায় সে ব্যাপারে তোমার কোনো আইডিয়া আছে? নাই। আশ্চর্য ব্যাপার! তোমাকেই ঠিকমতো পালতে পারছি না, যা-তা করে বেড়াচ্ছ, আবার তুমি সাব–কন্ট্র্যাক্টে বিড়াল নিয়ে এসেছ! এসব কোন ধরনের ফাজলামি?’
বিড়ালটা কী বুঝল কে জানে। ফুফার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ‘ম্যাও’ বলে এক পা দিয়ে কান চুলকাতে শুরু করল বসে বসে।
‘আজকেই ওকে দিয়ে আসব, ফুফা। আপনি টেনশন করবেন না।’
রুশার নম্বরে রিং হলো বেশ কয়েকবার। রিসিভ করল না। স্কুলে চলে গেল নাকি? হাল ছেড়ে দিল ইভান। রাহাতকে কল দিল এবার। দুবার রিং হতেই রিসিভ করল রাহাত।
‘এখনই দিয়ে আয় না বাবা।’ রান্নাঘর থেকে বললেন ফুফু। ‘বিকাল পর্যন্ত এই বিড়াল ঘরে থাকলে ঘরটর একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলবে।’
‘ওকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি আপাতত।’
‘আমি অফিস থেকে এসে যদি বিড়াল দেখি, দুজনকেই ঘর থেকে বের করে দেব বলে দিলাম।’ ফুফুর সমর্থন পেয়ে গলার জোর আরও বাড়ালেন ফুফা। ‘এটা ভদ্রলোকের বাসা। কুকুর বিড়ালের ডে কেয়ার খুলে বসি নাই আমি।’
নিজের মুখের চেয়েও বড় এক হাই তুলে মেঝেতে শুয়ে পড়ল বিড়ালটা। কড়া দৃষ্টি দিয়ে ওকে ভস্ম করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন ফুফা। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে এখনই দুই চোখ থেকে সুপারম্যানের মতো আগুন বেরিয়ে আসবে। কিন্তু ফুফা তো আর সুপারম্যান নন, একটা ছোট কোম্পানির চেয়ারম্যান। ফলে বিড়ালের কোনো ক্ষতি হলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন ফুফা। ‘আমি গেলাম’ বলে গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন।
বিড়ালটা কোলে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল ইভান। বারান্দায় পত্রিকা বিছিয়ে একটা বাটিতে দুধ খেতে দিল ওকে। সামনে দুই পা একটু ভাঁজ করে ঝুঁকে চুকচুক শব্দ করে দুধ খেতে লাগল বিড়াল। ফোনটা নিয়ে চট করে দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্দী করে ফেলল ইভান। ভিডিও করল কিছুক্ষণ। কল দিল রুশাকে। কখন কোথায় দেখা করবে ঠিক করে ফেলা দরকার। ফুফা এসে বাসায় বিড়াল দেখলে অযথা ঝামেলা করবে। চিৎকারে বিড়ালের কিছু হওয়ার কথা, ফুফার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। যদিও ফুফার চিৎকার খুব একটা গায়ে লাগায় না ইভান। কিন্তু চাপটা গিয়ে পড়ে ফুফুর ওপর। সেটা ও চায় না।
রুশার নম্বরে রিং হলো বেশ কয়েকবার। রিসিভ করল না। স্কুলে চলে গেল নাকি? হাল ছেড়ে দিল ইভান। রাহাতকে কল দিল এবার। দুবার রিং হতেই রিসিভ করল রাহাত।
‘হ্যাঁ, ইভান, বল।’
‘কই তুই?’
‘রেডি হচ্ছি, স্কুলে যাব। তুই আসবি?’
‘একবার ঢুঁ মারব টিফিন টাইমে। আমার তো আর ক্লাস নাই।’
‘আচ্ছা, এসে ফোন দিস।’
‘জিকো আর কিছু বলেছে?’
‘না, স্কুলে গেলে হয়তো বলবে।’
‘এর মধ্যে যদি কিছু বলে, তাহলে আমাকে কল দিস। আমি চলে আসব।’
‘ওকে।’
‘আর শোন, একা কিছু করতে যাবি না। ওর সাথে পোলাপান থাকে সব সময়। রিস্ক নিবি না।’
‘ঠিক আছে। রাখি এখন। নইলে লেট হয়ে যাবে।’
‘রাখ।’
ইভান টের পেল বেশ খিদে পেয়েছে ওর। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসল তাড়াতাড়ি। নাশতা তৈরি ছিল টেবিলে। শুধু একটা ডিম পোচ করে দিলেন ফুফু। চেয়ার টেনে ইভানের পাশে বসে বললেন,
‘তোর ফুফার কথায় মন খারাপ করিস না।’
‘আরে না। মন খারাপ করি নাই।’
‘লোকটা পশুপাখি পছন্দ করে না।’
‘প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে মনে হয়।’
‘অ্যাই! বেয়াদবি করছিস কেন? ফুফা না তোর? সবজি খাচ্ছিস না কেন? খা।’
‘খাচ্ছি।’
‘নাশতা খেয়ে বিড়ালটা ফেলে দিয়ে আসবি।’
‘সময় লাগবে ফুফু। এক ফ্রেন্ড নেবে বলেছে। কিন্তু স্কুল ছুটির পর। ফুফা আসার আগেই আমি ওকে নিয়ে যাব, তুমি কোনো চিন্তাই কোরো না।’
‘ঠিক আছে।’
‘দুপুরে মাছ বা মুরগি রান্না কোরো। বিড়ালটা তো চলেই যাবে। ভালো কিছু খেয়ে যাক।’
‘ওরে বাপরে! শখ তো কম না তোর। যা ভাগ।’
ঘরে এসে পড়তে বসল ইভান। এক ফাঁকে গেম খেলল কিছুক্ষণ। তারপর গোসল সেরে রেডি হয়ে নিল দ্রুত। টিফিনের আগেই স্কুলে গিয়ে পৌঁছাতে চায় ও। বিড়ালটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। দরজা ভালোমতো আটকে ফুফুকে বলে বেরিয়ে গেল ইভান। সময় আছে, তাই হেঁটেই রওনা দিল স্কুলের দিকে।
হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের পেছন দিকে চলে এল ও। ভাঙা দেয়ালটার সামনে লোকজনের জটলা। ফিতা দিয়ে দেয়াল মাপছে একজন। ‘রিপেয়ারের কাজ শুরু হয়ে গেছে তাহলে। ভালো চাল চেলেছে কাউন্সিলর।’ ভাবল ইভান। স্কুলে না ঢুকে বাইরের গলিতে গাছপালার নিচে দাঁড়াল ও। কল করল রাহাতকে। কেটে দিল রাহাত। ক্লাস এখনো শেষ হয়নি। কোথায় আসতে হবে এসএমএসে লিখে জানাল ইভান। কিছুক্ষণ পরই ঘণ্টা বাজল টিফিনের। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে এল রাহাত। হাতে দুটো শিঙাড়া। ইভানকে একটা শিঙাড়া দিল রাহাত। নিজে কামড় বসাল আরেকটায়।
‘জিকো আর কিছু বলেছে?’ জিজ্ঞাসা করল ইভান।
‘উহু।’ মাথা নাড়ল রাহাত।
‘দেখেছিস ওকে?’
‘হ্যাঁ, কলেজে এসেছে।’
‘চল তাহলে। দেখা করে আসি।’
‘মোড়ের দোকানে আছে ও, আমি শিওর।’
‘হ্যাঁ, টিফিনের সময় ওখানেই আড্ডা দেয় ও। চল।’
দ্রুত হেঁটে মোড়ের দোকানগুলোর সামনে চলে এল ওরা। দূর থেকেই দেখতে পেল বন্ধুদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছে জিকো। সোজা সেদিকেই চলে গেল ইভান আর রাহাত। ওদের দেখে কাপটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে রেখে উঠে দাঁড়াল জিকো।
‘কিরে, ফার্মের মুরগিরা, তোরা মাইর খাইতে চইলা আসলি?’ হেসে বলল জিকো। ‘আমারে বললেই তো একদম জায়গায় গিয়া মারতাম। হোম ডেলিভারি।’
‘দরকার পড়লে মাঝেমধ্যে আমরাও হোম ডেলিভারি দিতে আসি।’ ঠান্ডা স্বরে বলল ইভান।
‘তোর কথার ধার বাইড়া গেছে দেখি। ছুরিটা রাইখা ভালোই করছি। কী কস তোরা?’ আশপাশের বন্ধুদের দিকে তাকাল জিকো। হেসে মাথা নাড়ল ওরা।
রাহাত আর রাজন গেল ক্লাসের দিকে। বাসার দিকে গেল ইভান। বাসায় গিয়েই আরেকবার গোসল সেরে নিল। দুপুরে খেয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল বই পাশে রেখেই। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না ইভান। ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। অচেনা নম্বর। রিসিভ করল ইভান।
‘খেলার কথা বলেছিলেন, খেলার খোঁজ নিতে আসলাম।’ রাহাত বলল।
‘হ, খেলা তো হইব। কিন্তু তোরা বুঝতেও পারবি না খেলা কোন কোন মাঠে হইতেছে। কারা কারা খেলতেছে।’
‘আপনি ঠিকমতো জানেন তো?’ জিজ্ঞাসা করল ইভান। ‘পরে দেখা যাবে নিজেরা নিজেরা খেলছেন। সব সময় যে রকম খেলেন আরকি।’
খপ করে ইভানের গেঞ্জির কলার চেপে ধরল ইভান। ফোঁস করে উঠল রাহাত।
‘আপনার খেলা তো আমরা জানি ভাই।’ বলল ইভান। ‘সামনাসামনি কিছু করতে পারেন না। জুনিয়রদের সঙ্গে লাগতে আসেন, তা–ও চোরের মতো ব্যাগে ছুরি রেখে৷ এসবই তো আপনার খেলা। তাই না?’
ঘুষি মারার জন্য হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছিল জিকো। কী ভেবে থেমে গেল। ‘ছুটির পর থাকিস।’ বলল মুখ বাঁকিয়ে। ‘তোরে বোঝায় দিমু খেলা কারে বলে।’ একটা ধাক্কা দিয়ে ইভানকে ছেড়ে দিল জিকো।
পকেট থেকে মুঠোফোন বের করল ইভান। কিছু একটা ঘাঁটার ভঙ্গি করে বলল, ‘শিডিউল নাই ভাই। অ্যাপ্লিকেশন করেন, দেখি টাইম ম্যানেজ করতে পারি কি না। আপনার মতো ফ্রি টাইম তো নাই আমাদের।’
ইভানের দিকে তেড়ে আসছিল জিকো। পেছন থেকে ওকে ঠেকাল বন্ধুরা। ঠিক তখনই ঘণ্টা বেজে উঠল।
‘ওই জিকো, বাদ দে। পরে দেখা যাবে।’ বলল জিকোর বন্ধুরা।
বেঞ্চে রাখা চায়ের কাপটা হাতে নিল জিকো। এক চুমুক দিয়ে থু করে চা ফেলল ইভানের পায়ের সামনে। লাফ দিয়ে সরে গেল ইভান। শব্দ করে কাপটা রেখে বন্ধুদের নিয়ে গটগট করে হেঁটে গেল জিকো।
‘আস্ত শয়তান একটা!’ বলল রাহাত।
‘চল আগাই।’ বলে সামনে এগোল ইভান।
রাস্তার উল্টো পাশ থেকে ওদের দিকে দৌড়ে এল রাজন।
‘ভিডিও করেছিস?’ রাজনকে জিজ্ঞাসা করল ইভান।
‘একদম। যেভাবে বলেছিলি।’
‘শাবাশ কাকা!’ পিঠ চাপড়ে বলল রাহাত।
‘ভিডিওটা কাজে লাগতে পারে। ঠিক আছে, তোরা ক্লাসে যা। আমি বাসায় যাই।’
‘আচ্ছা, বিকেলে দেখা হবে।’
রাহাত আর রাজন গেল ক্লাসের দিকে। বাসার দিকে গেল ইভান। বাসায় গিয়েই আরেকবার গোসল সেরে নিল। দুপুরে খেয়ে একটা গল্পের বই নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। একসময় ঘুমিয়ে পড়ল বই পাশে রেখেই। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না ইভান। ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। অচেনা নম্বর। রিসিভ করল ইভান।
‘হ্যালো।’
‘ইভান ভাই?’
‘হ্যাঁ, কে?’
‘আমি অনিক। ভাই, রকিরে মারতেছে কিছু পোলাপান। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।’
‘বলো কী? মারছে কেন? কারা মারছে?’
‘বাইরের পোলাপান। আপনি আসেন তাড়াতাড়ি।’
‘আচ্ছা, আমি আসছি।’
থ্রি–কোয়ার্টার প্যান্ট আর ঢিলা গেঞ্জি পরে শুয়ে ছিল ইভান, সেভাবেই বেরিয়ে গেল। লাফিয়ে লাফিয়ে নামল সিঁড়ি দিয়ে। রকির গায়ে কারা হাত তুলতে পারে? জিকোরা? ভাবার সময় নেই। ঘটনাস্থলে গিয়েই দেখতে হবে। যারাই হোক, পরিণতি ভালো হবে না ওদের। মনে মনে ভাবল ইভান। নিশ্চয়ই জানে না, কার গায়ে হাত দিয়েছে ওরা।
চলবে…
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619