ইভানদের বাসার সামনের গলিটা এমনিতেই ব্যস্ত থাকে সারা দিন। বিকেল হলে ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। দুপুরের ভাতঘুম শেষে যেন জেগে ওঠে গলি। মানুষের কোলাহল, রিকশার টুংটাং বেল, ব্যাটারি রিকশার প্যাঁ পোঁ হর্ন আর শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে শোনা যায় মশা তাড়ানোর ফগার মেশিনের শব্দ। সবকিছুর পাশ কাটিয়ে গলি ভেতর দিয়ে ছুটছে ইভান। অফিস–ফেরত মানুষগুলো একবার অবাক হয়ে তাকাল ওর দিকে। তারপর আবার মনোযোগ দিল সবজিভর্তি ভ্যানের ওপর। সকাল আর বিকেলে এই গলিতে ভ্যানে করে শাকসবজি, ফল বিক্রি করে বিক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতা, ঘরমুখী মানুষ—সবাইকে পাশ কাটিয়ে ছুটছে ইভান। এক দৌড়ে তিনটা গলি পেরিয়ে চলে এল আমতলায়। তিনটা গলি এসে মিলেছে এখানে। দূর থেকেই আমতলা পানির পাম্পের সামনে বিকেলে খেলতে নামা কিছু ছেলেমেয়ের জটলা দেখতে পেল ইভান। কাছাকাছি এসে গতি কমাল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে জটলা ঠেলে ঢুকল ভেতরে। সামনে দুই পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে আছে রকি। মাথা ফেটে গেছে ওর। পেছনের পায়েও বোধহয় আঘাত পেয়েছে, দাঁড়াতে পারছে না। করুণ চোখে এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে কুকুরটা। ব্যথায় চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে রকি। জিব বের করে হাঁপাচ্ছে শুধু।
হাঁটু গেড়ে কুকুরটার পাশে বসল ইভান। ওকে দেখেই কুঁইকুঁই শব্দে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল কুকুরটা। নড়তেই পারল না। রকির পিঠে হাত বুলিয়ে দিল ইভান। আশপাশে তাকিয়ে বেছে নিল একটা ছোট্ট ছেলেকে। ২০ টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ইভান বলল, ‘একটা পানি নিয়ে আসো তো।’ টাকা নিয়েই দোকানের দিকে দৌড় দিল ছেলেটা।
কয়েক বছর আগে এই রকিকে উদ্ধার করেছিল ইভান। রাস্তা পার হতে গিয়ে বড় ড্রেনটায় পড়ে গিয়েছিল রকি। অনেকক্ষণ পড়ে থাকার পরও এগিয়ে আসেনি কেউ। স্কুল থেকে ফেরার সময় ইভান শুনল, ড্রেন থেকে বাচ্চা কুকুরের চিৎকার ভেসে আসছে। দ্রুত ড্রেনের কাছে গিয়ে বসল হাঁটু গেড়ে। ছটফট করতে থাকা কুকুরছানাটাকে দুই হাতে ধরে হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলেছিল ইভান। সেই থেকে এই এলাকাতেই আছে কুকুরটা। এলাকার সবাই ওকে আদর করে। ‘রকি’ বলে ডাকলেই ছুটে আসে। চায়ের দোকানে চা খেতে আসা মানুষ রুটি বিস্কুট কেক খেতে দেয় ওকে। ইভানের সঙ্গে রকির সম্পর্ক অন্য রকম। গলিতে হাঁটতে বেরোলেই ওর সঙ্গে হাঁটে রকি। ইভান যদি চায়ের দোকানে বসে, রকিও বসে থাকে ওর পায়ের কাছে। প্রিয় কুকুরকে এই অবস্থায় দেখে চোখে পানি চলে এল ইভানের। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল ও। ঘাড় বাঁকা করে ওর দিকে তাকাল রকি৷ চোখ দুটো দেখে মনে হলো, ইভানকে আশ্বস্ত করে বলছে, ‘চিন্তা কোরো না। মরি নাই এখনো।’
ততক্ষণে পানির বোতল নিয়ে ছুটে এসেছে ছেলেটা। পানি দিয়ে রকির মাথার কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করল ইভান। জখমটা কতটুকু তা বোঝা দরকার। মনে হলো শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে মাথায়।
‘মারল কারা?’ পানি এনে দেওয়া ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘চিনি না তো। রকি শুইয়া ছিল রিল্যাক্সে। তিনটা পোলা আসল বাইকে। আইসা হুদাই লাত্থি দিল ওরে।’
‘শুধু শুধু লাথি মারল?’
‘হ। লাত্থি খাইয়া রকি চেইতা গেল। তখন একটা পোলা ইশটিলের ইস্কেল দিয়া ওর মাথায় দিল বাড়ি। হেরপর একটা বড় ইটা লইয়া ওর পায়ে ঢিলা মারল। তখনই রকি খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে এইখানে আইসা বসছে। আর উঠে নাই।’
‘ছেলেগুলো কী করল?’
‘চইলা গেল। রকির চিল্লানি শুইনা লোকজন ছুইটা আইল। তখন তাড়াতাড়ি চইলা গেল পোলাগুলা। দেইখা মনে হইল অনেক মজা পাইসে ওরা। হেব্বি শয়তান পোলাগুলা।’
ইভানের মনে হলো রকিকে এখনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। এখান থেকে বেশ দূরে পেট কেয়ার সেন্টার নামে একটা ক্লিনিক আছে। সেখানেই নিয়ে যাবে রকিকে। একটা রিকশা ডাকল ইভান। ৩–৪ বছর বয়সী একটা আহত কুকুরকে রিকশায় তোলা সহজ ব্যাপার নয়। কয়েকজন মিলে ধরে রকিকে রিকশার পা দানিতে তুলল ওরা। তারপর রিকশায় উঠে বসল ইভান।
আহত কুকুর নিয়ে রিকশায় করে যাচ্ছে একটা ছেলে—দৃশ্যটা দেখে কৌতূহলী হলো রাস্তার লোকজন। সিগন্যালে-জ্যামে রিকশা থামার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন আসতে শুরু করল আশপাশ থেকে।
‘অ্যাক্সিডেন্ট নাকি? গাড়ির তলে পড়সে?’
‘মারামারি করসে নিজেরা নিজেরা?’
‘কী একটা ঝামেলায় পড়লা। ফালায় রাখতা এক কোনায়।’
ব্যস্ত হয়ে পড়ল রিসেপশনিস্ট। আগ্রহ নিয়ে তাকাল নিজেদের পোষা বিড়াল, কুকুরের চিকিৎসা করাতে আসা মানুষ। একটু পরই ভেতর থেকে ছুটে এল একজন। ইভানকে দেখে বলল, ‘কুকুর কই?’
‘আরে ভাই, দেশে মানুষেরই নিরাপত্তা নাই। তুমি আছো কুত্তা নিয়া। তোমারে বলি শোনো, সেদিন আমার এক আত্মীয় বাসে করে যাচ্ছে। আতকা টান দিয়ে তার ফোনটা নিয়ে গেল ছিনতাইকারী। চিন্তা করো অবস্থা।’
লোকজনের কথা পাত্তাই দিল না ইভান। কিছু বলতে গেলেই কথা বাড়বে। শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে কী লাভ? ওর মনে হলো, এটা ফেসবুক হলেই এই মানুষগুলো খুব আহা-উহু করত। স্যাড রিঅ্যাকশনে ভেসে যেত পোস্ট। বাস্তবে কিন্তু চাইলেই ইভানকে বাহবা দিতে পারত লোকগুলো। জিজ্ঞেস করতে পারত কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কোনো সাহায্য লাগবে কি না। এগুলো না করে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে বোধহয় বেশি ভালোবাসে মানুষ।
পেট কেয়ার সেন্টারের সামনে এসে রিকশা থেকে নামল ইভান। রিকশাওয়ালা মামার সঙ্গে মিলে নিচে নামাল রকিকে। ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত ভেতরে গেল ইভান। ক্লিনিকের একজন কর্মীর সাহায্য লাগবে রকিকে ভেতরে নিয়ে যেতে। ইভানকে চেনে ক্লিনিকের সবাই। ওকে দেখেই রিসেপশনে বসা কর্মী বলে উঠল, ‘কী, আবার রেসকিউ? কুকুর না বিড়াল?’
‘রেসকিউ না ভাই। রকিকে মনে আছে? ওকে মেরেছে কারা যেন।’
‘আয়হায়, বলো কী!’
‘বাইরে রেখে এসেছি। কাউকে একটু ডাকেন, ধরে ভেতরে নিয়ে আসি।’
ব্যস্ত হয়ে পড়ল রিসেপশনিস্ট। আগ্রহ নিয়ে তাকাল নিজেদের পোষা বিড়াল, কুকুরের চিকিৎসা করাতে আসা মানুষ। একটু পরই ভেতর থেকে ছুটে এল একজন। ইভানকে দেখে বলল,
‘কুকুর কই?’
‘বাইরে।’
‘চলো।’
দুজন মিলে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে এল রকিকে। ভেতরে বসে থাকা সবাই আঁতকে উঠল রকির অবস্থা দেখে। একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দেওয়া হলো ওকে। ভেতর থেকে স্লাইডিং দরজাটা বন্ধ করে দিলেন ডাক্তার। কী হয়েছে তাঁকে খুলে বলল ইভান। গ্লাভস পরা হাতে হেক্সিসল দিয়ে রকির ক্ষতস্থান দেখতে লাগলেন ডাক্তার। কাটা জায়গাটায় স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে ওঠার জন্য ছটফট করে উঠল রকি। কুঁইকুঁই আওয়াজ করতে লাগল ও। ডাক্তারের সহকারী দ্রুত চেপে ধরল ওকে। এমন দৃশ্য আগেও দেখেছে ইভান। তারপরও খুব খারাপ লাগল। ডাক্তারকে বলে বাইরে বেরিয়ে এসে বসল ও।
পকেট থেকে ফোন বের করল ইভান। বিকেলে যে নম্বর থেকে কল করেছিল অনিক, ডায়াল করল সেই নম্বরে। রিসিভ করল অনিক।
‘ভাই, আপনি কই?’
‘রকিকে নিয়ে এসেছি ক্লিনিকে। তুমি কই?’
‘আমি ভাই ৪ নম্বর রোডে। রকিরে যে পোলাপান মারসে, ওদের দেখলাম জিকো ভাইয়ের সাথে, চায়ের দোকানে।’
‘ছবি তুলতে পারবা কোনোভাবে?’
‘আমি ওদের থেকে দূরে আছি ভাই। আর আমার ফোনের ক্যামেরা তো অত ভালো না। তা-ও চেষ্টা করব।’
‘ঠিক আছে। তুলতে পারলে ছবিটা আমাকে পাঠায় দিয়ো।’
‘ওকে ভাই।’
অনিকের সঙ্গে কথা শেষ করেই রাহাতকে কল করল ইভান।
‘রাহাত, তুই কই?’
‘আমি তো বাসায়।’
‘বের হবি? আমি পেট কেয়ার ক্লিনিকে আসছি রকিকে নিয়ে।’
‘ওর আবার কী হয়েছে?’
‘কারা যেন মেরে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তুই আয়।’
‘আচ্ছা, আমি আসছি। থাক ওখানে।’
আমার ওপর শোধ নেওয়ার জন্য এই কাজ করল জিকোরা?’ ওয়েটিংরুমের বেঞ্চে বসে ভাবল ইভান।
‘ওটা তোমার কুকুর?’ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল একজন। তার কোলে একটা সাদা পার্শিয়ান বিড়াল।
‘রেসকিউ করেছিলাম। এখন আমাদের এলাকায় থাকে।’
‘আচ্ছা। কীভাবে হলো এ রকম?’
‘ওকে মেরেছে কয়েকটা ছেলে।’
‘কী আশ্চর্য! মানুষ হিংস্র হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।’
মাথা নাড়ল ইভান। প্রাণীদের প্রতি মানুষের হিংস্রতা ছোটবেলা থেকেই দেখছে ও। একটা কুকুর শুয়ে আছে, কোনো কারণ ছাড়াই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোক একটা লাথি দেবে কুকুরটাকে। কিংবা পানি ঢেলে দেবে গায়ে। হয়তো কোনো সানশেডে বসে আছে একটা বিড়াল। অযথাই ওর দিকে ঢিল মারবে মানুষ। ভয় পেয়ে লাফিয়ে পালাবে বিড়াল—এটাই বোধ হয় ওদের মজা।
পেছন থেকে ইভানের মাথায় হালকা টোকা মেরে পাশে এসে বসল রাহাত।
‘কিরে, কী অবস্থা এখন?’
‘এই তো। ভেতরে ট্রিটমেন্ট চলছে।’ একটু সরে রাহাতকে বসার জায়গা করে দিয়ে বলল ইভান।
‘কী বলল ডাক্তার?’
‘বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। এখন দেখা যাক, কী হয়। ওকে কারা মেরেছে জানিস?’
‘কারা?’
‘জিকোরা।’
‘বলিস কী? তোর সামনে মারল?’
‘আরে না। আমি তো বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম। অনীক আছে না? আমতলার ওই দিকে থাকে? ও আমাকে ফোন করে জানাল। জিকো ছিল না। কিন্তু যে ছেলেগুলো মেরেছে, ওদের পেছন পেছন গেছে অনীক।’
‘তারপর?’
‘গিয়ে দেখে ওরা জিকোর সঙ্গে আড্ডা মারছে।’
‘না, তাহলে ঘা শুকাতে দেরি হবে। ইনফেকশনও হয়ে যেতে পারে। তোমরা প্রতিদিন নিজেরা একটু ড্রেসিং করিয়ে দিয়ো। আর পাউডারটা দিতে থাকো রেগুলার। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয়, তোর ওপর শোধ নিতে এই কাজ করিয়েছে জিকো। বলল না, এমন কিছু করবে যে আমরা ধরতেই পারব না?’
‘আমারও তা–ই মনে হয়। ছেলেটা খারাপ এটা জানতাম। এত খারাপ এটা ভাবি নাই। নিরীহ একটা প্রাণীর ওপর দিয়ে শোধ নিল। ওকে সুযোগ বুঝে ঢালাই দিতে হবে।’
‘ইভান, ভেতরে আসো তো একটু।’ ভেতর থেকে ডাকলেন ডাক্তার। দ্রুত উঠে ভেতরে গেল ইভান আর রাহাত। রকিকে দেখেই গা শিরশির করে উঠল ওদের। রকির মাথার মাঝখানে গোল করে চামড়া কেটে ফেলা হয়েছে। হাঁ হয়ে আছে কাটা জায়গাটা, মাংস দেখা যাাচ্ছে। ড্রেসিং করে পরিষ্কার করা হয়েছে ক্ষতস্থান। ‘কয়েক সপ্তাহ একটু কেয়ার নিতে হবে।’ বললেন ডাক্তার। ‘কিছু ওষুধ লিখে দিলাম, আর একটা পাউডার। পাউডারটা তিন–চারবার করে দিতে হবে কাটা জায়গায়।’
‘ব্যান্ডেজ করে দিলে ভালো হতো না?’ জিজ্ঞেস করল রাহাত।
‘না, তাহলে ঘা শুকাতে দেরি হবে। ইনফেকশনও হয়ে যেতে পারে। তোমরা প্রতিদিন নিজেরা একটু ড্রেসিং করিয়ে দিয়ো। আর পাউডারটা দিতে থাকো রেগুলার। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘পা ঠিক আছে?’ ইভান বলল।
‘পায়ে ভালো ব্যথা পেয়েছে। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। ভাঙে নাই।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
‘আরে ধন্যবাদ তো তুমি পাবা। তোমার মতো মানুষদের কারণে রাস্তার কুকুরগুলো এখনো বেঁচে আছে। কোনো হেল্প লাগলে জানাবে আমাকে।’
নিজের কানে বন্ধুর প্রশংসা শুনে গর্বে বুক ফুলে গেল রাহাতের। ওরা সবাই মিলে রকিকে ধরে নামাল নিচে। দৌড়ে গিয়ে একটা রিকশা ডেকে নিয়ে এল রাহাত। ধরাধরি করে রকিকে রিকশায় তুলে উঠে বসল ওরা।
‘কিরে মামা, ডাক্তার তো তোকে সেই বাটার দিল।’ হেসে বলল রাহাত। ‘তোমার মতো মানুষদের কারণে কুকুরগুলো আজও বেঁচে আছে, আজও ওরা হাসে, গান গায়…মানুষকে তাড়া করে…’
‘আরে ধুর। বাদ দে।’ লজ্জা পেল ইভান।
‘এএএ লজ্জা পাইসে।’
‘থামবি তুই? ছাগল কোথাকার।’ ইভানও হেসে ফেলল।
আমতলা পাম্পের সামনে এসে নামল ওরা। রকিকে নামাল সাবধানে। অধিকাংশ সময়েই একটা দোকানের সিঁড়িতে ঘুমায় রকি। দীর্ঘদিন ধরেই দোকানটার শাটার বন্ধ। সেই সিঁড়িতেই রকিকে শুইয়ে দিল ওরা। পাশের চায়ের দোকানদারকে খেয়াল রাখতে বলে বাসার দিকে হাঁটা দিল ইভান আর রাহাত। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আগেই। আর দেরি করা ঠিক হবে না।
দ্রুতই বাসায় চলে এল ওরা। দরজা খুলেই ইভানের ফুফু বললেন,
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
‘এই তো, নিচেই ছিলাম।’
‘তোদের হেডস্যার ফোন করেছিল।’
চমকে উঠল ইভান আর রাহাত।
‘কী বলল?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘কাল থেকে স্কুলে যেতে বলেছে তোকে। ওই ছুরিতে তোর আঙুলের ছাপ পাওয়া যায়নি।’
চুপ করে রইল ইভান। আলতো করে ওর পিঠ চাপড়ে দিল রাহাত।
‘তোরা হাত–মুখ ধুয়ে নে। নুডলস বানিয়েছি। খাবি।’
‘জি ফুফু।’ বলে মুহূর্তের মধ্যে বাথরুমে ঢুকে গেল রাহাত। ভাবটা এমন যে এই মুহূর্তে নুডলস খাওয়া ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই ওর। ইভান ওর ঘরে ঢুকল। এর মধ্যেই দ্রুত বেরিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল রাহাত। ওকে বসতে দেখে ফুফু বললেন,
‘তোমাকে এখন দেব? নাকি ইভান আসলে খাবে?’
‘এখনই দেন ফুফু।’ ইভানের আসতে দেরি হবে।’
বাটিতে নুডলস দেওয়ামাত্র খাওয়া শুরু করল ও। ইভান বেরিয়ে এসে দেখে বুভুক্ষুর মতো খাচ্ছে রাহাত।
‘ফুফু!’ বলল ইভান।
‘কী রে?’
‘আমার বিড়ালটা কোথায়?’
‘ওহ হো, তোকে বলা হয় নাই। তোর ফুফা এসে দেখে বিড়াল ম্যাও ম্যাও করছে। পরে তো খুব খেপে গেল তোর ফুফা। দারোয়ান ডেকে বিড়ালটাকে বের করে দিয়েছে।’
‘মানে কী! তোমরা আমাকে বলবা না একবার?’
‘তোকে তো ফোন করেছিলাম, ধরিস নাই।’
‘ধুর!’
‘কোথায় যাচ্ছিস? খাবি না?’
‘রাহাত, চল।’ স্যান্ডেল পরতে পরতে বলল ইভান।
‘কোথায় যাব?’ মুখভর্তি নুডলস নিয়েই বলল রাহাত।
‘বিড়ালটাকে খুঁজতে।’
‘নুডলসটা খেয়ে যাই, কী বলিস?’
‘হ্যাঁ, খেয়ে যা।’ বললেন ফুফু।
‘রাহাত! তুই যাবি?’
‘যাচ্ছি।’ দ্রুত কয়েক চামচ নুডলস মুখে পুরে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল রাহাত।
লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে লাগল ওরা। নিচে এসে ইভান চলে গেল দারোয়ানের রুমে। স্যাঁতসেঁতে ঘরে আরাম করে শুয়ে মোবাইলে অদ্ভুত এক গান শুনছিল দারোয়ান চাচা। ওদের দেখে চমকে উঠে দাঁড়াল।
‘ভাতিজা, তুমি?’
‘আমার বিড়ালটা কোথায় রেখেছেন?’
‘বিশ্বাস করো ভাতিজা, আমার কোনো দোষ নাই। তোমার ফুফা কইসে এমন জায়গায় ফালাইতে, যেন আর ফিরা না আসতে পারে।’
‘কোথায় ফেলেছেন, বলেন!’
‘প্রথমে তো ব্যাগে ভইরা গেটের বাইরে ফালায় আসমু ভাবসিলাম। পরে ভাবলাম পিছে পিছে আবার আইসা পড়বে। ঝমেলা।’
‘তারপর?’
‘হেরপর মেইন রোডে নিয়া গেলাম।’
‘আয়হায়!’ ভয় পেয়ে গেল রাহাত।
চুপ করে রইল ইভান। যুক্তি আছে রাহাতের কথায়। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো ওর। এত কষ্ট করে বিড়ালটাকে আগলে রাখল এত দিন, আর আজকে এমন একটা কাণ্ড ঘটল? রকিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কয়েক ঘণ্টার জন্য বিড়ালটার কথা ভুলে গিয়েছিল ইভান।
‘চিন্তা করলাম, মেইন রোডে ফালায় গেলে গাড়ির তলে পড়তে পারে। দেখলাম পাম্পের সামনে একটা পিকআপ দাঁড়াইয়া আছে। আরও কী কী মালপত্র ছিল পিকআপে। ব্যাগটা পিকআপে রাইখা দিলাম। একটু পর পিকআপটা গেলগা।’
‘আয়হায়!’ বলল রাহাত।
ইভান কড়া চোখে তাকিয়ে রইল দারোয়ান চাচার দিকে। চোখ নামিয়ে নিলেন চাচা।
‘আমার কী দোষ? স্যারে কইল…’
‘আমিও বড় হব, আপনিও এখানেই থাকবেন। আপনাকে আমি এক দিন ধরে বেঁধে একটা পিকআপে তুলে দেব।’
‘এইডা কী কও ভাতিজা!’
ঝট করে ঘুরে গেট দিয়ে বের হয়ে গেল ইভান। পেছন পেছন গেল রাহাত।
‘কই যাস ইভান?’
‘মেইন রোডে গিয়ে দেখি একবার।’
‘কোনো লাভ নেই।’
‘জানি। তা-ও দেখি।’
গলি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই মেইন রোড। দুজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল মেইন রোডে। পেট্রলপাম্পের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
‘দোস্ত, এখানে বিড়াল খোঁজা আর হেডস্যারের মাথায় চুল খোঁজা একই রকম।’
‘কীভাবে?’
‘স্যারের মাথায় চুল নাই, এইখানেও বিড়াল নাই। যে জিনিস নাই সেটা খুঁজবি কীভাবে?’
চুপ করে রইল ইভান। যুক্তি আছে রাহাতের কথায়। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলো ওর। এত কষ্ট করে বিড়ালটাকে আগলে রাখল এত দিন, আর আজকে এমন একটা কাণ্ড ঘটল? রকিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কয়েক ঘণ্টার জন্য বিড়ালটার কথা ভুলে গিয়েছিল ইভান। নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে ওর। রাহাতকে বললেই ও বাসা থেকে নিয়ে আসতে পারত। সে ক্ষেত্রে ফুফার সামনেই পড়ত না বিড়ালটা।
‘দোষটা আসলে রুশার।’ বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল ইভান।
‘রুশাটা আবার কে?’
‘আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে। নতুন এসেছে।’
‘নতুন এসেছে? তুই চিনলি কীভাবে?’
‘যেদিন আমাকে বের করে দিল ক্লাস থেকে, সেদিনই পরিচয় হয়েছে। অদ্ভুত মেয়ে। বলল, বিড়ালটা নেবে। ওরই ফোন দেওয়ার কথা, দিল না। আমি এতবার ফোন দিলাম, ধরল না। ও বিড়ালটা নিয়ে নিলেই তো হতো, ফুফার সামনে পড়ত না বেচারা।’
‘ফোন দিয়া ঝাড়ি দে ওরে। আমি যাই বাসায়। টানা কয়েক দিন দেরি হচ্ছে। পরে আমাকে ঝাড়ি দেবে।’
‘যা। কাল স্কুলে দেখা হবে।’
আমতলার পাম্পের গলির দিকে হাঁটা দিল ইভান। রকির কী অবস্থা, একবার দেখে যেতে চায়। দোকানের সিঁড়ির কাছে এসে দেখল চুপচাপ শুয়ে আছে রকি। ফার্মেসি থেকে নেভানল পাউডার কিনেছে আগেই। পকেট থেকে বের করে পাউডার দিয়ে দিল কাটা জায়গায়। করুণ চোখে তাকিয়ে ক্রমাগত লেজ নেড়ে যাচ্ছে রকি। ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করল ইভান। তিন রাস্তার মোড়ে আসতেই বাইকের হেডলাইটের আলো এসে লাগল ওর চোখে। হাত দিয়ে আলো থেকে চোখ আড়াল করল ইভান। ভটভট শব্দ করে বাইক এসে ব্রেক কষল ইভানের একেবারে সামনে।
‘কিরে ফার্মের মুরগি এত রাতে বাইরে ক্যান? তোর তো সন্ধ্যার আগেই খোপে ঢুইকা যাওয়ার কথা।’ স্টার্ট বন্ধ না করেই বলল জিকো। ঝট করে মেজাজ চড়ে গেল ইভানের। ‘যা ব্যাটা, সর এখান থেকে।’ ধমক দিল ও। তাজ্জব হয়ে গেল জিকো। দ্রুত বাইক স্ট্যান্ড করিয়ে নেমে দাঁড়াল ও। ইভানের বুকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘কিরে, আমারে তুই বললি ক্যান? আমি তুই? সিনিয়র না আমি?’
‘তোর মতো বদ আবার কিসের সিনিয়র?’
‘দেখ, কথাবার্তা ঠিকমতো ক। নইলে রাস্তার কুত্তার মতো তোরও মাথাটা ফাটবে।’
‘জানি তো, তোর মতো ফাউল ছাড়া এমন কাজ আর কেউ করতে পারে না।’
খপ করে ইভানের গেঞ্জির কলার চেপে ধরল জিকো। টানতে টানতে ওকে টেনে নিয়ে গেল দেয়ালের পাশে, যেখানে পৌঁছায় না ল্যাম্পপোস্টের আলো। জিকোর শক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করল ইভান, লাভ হলো না। আবছা অন্ধকারে ও টের পেল, পকেট থেকে কী যেন বের করছে জিকো। কী করবে এখন? ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল ইভান। ভুরু কোঁচকাল জিকো। ‘করে কী ব্যাটা?’ ভাবল জিকো। হঠাৎ ঠোঁট সরু করে তীক্ষ্ণ শব্দে বেশ কয়েকবার শিস বাজাল ইভান। ব্যাপারটায় খুব মজা পেল জিকো। হাসতে হাসতে কলার ছেড়ে বলল, ‘তুই ব্যাটা একটা পিওর ফার্মের মুরগি। যাহ, ছাইড়া দিলাম আজকে।’ ইভানের কলার ছেড়ে দিল জিকো পেছনে সরে আসতেই ও টের পেল, ইভানকে হালকাভাবে নিয়ে কত বড় ভুল করেছে সে। আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে এল ওর। অসাড় হয়ে এল পা।
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619