কুঁচকে যাওয়া গেঞ্জিটা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে নেওয়ার চেষ্টা করল ইভান। খেয়াল করল, আতঙ্কে চেহারা বদলে গেছে জিকোর। কারণ, বিকট শব্দে ঘেউ ঘেউ করতে করতে তীব্রগতিতে দৌড়ে আসছে ডগেশ—ওর সবচেয়ে অনুগত কুকুর। দেয়াল থেকে একটু সামনে এগিয়ে এল ইভান। ‘কিরে ফার্মের মুরগি, ভয় লাগছে নাকি তোর?’ ব্যঙ্গ করে বলল জিকোকে। জবাব দিল না জিকো। পকেট থেকে বের করা ছোট ছুরিটা ঢুকিয়ে ফেলল বাঁ পাশের পকেটে। খুব সতর্ক হয়ে চেষ্টা করল পেছানোর। একেবারে ওর সামনে এসে ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করছে ডগেশ। আদেশের অপেক্ষায় ইভানের দিকে তাকাচ্ছে কুকুরটা। সাড়া পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারি নেকড়ের মতো।
‘কিরে, দাঁড়া। তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।’ জিকোকে বলল ইভান। এবারও কোনো জবাব দিল না জিকো। চুপচাপ পিছিয়ে গেল আরও। হুংকার দিয়ে এগোল ডগেশ।
‘ই-ইভান, এটারে থামা। ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে না কিন্তু।’ ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে জিকো।
‘তোরা যে আমার কুকুরটাকে মারলি, সেটা খুব ভালো? যা যা করলি আমার সঙ্গে, সেগুলো খুব ভালো, তাই না?’ খেপে গেল ইভান। ওকে রাগ করতে দেখে যেন আরও ছটফট করতে শুরু করল ডগেশ।
‘এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, ইভান।’ বাইকের কাছে সরে গেল জিকো। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল ইভান। দ্রুতবেগে বাইকে উঠেই স্টার্ট দিল জিকো। হেডলাইট জ্বালাতেই রীতিমতো গর্জন করে উঠল ডগেশ। ‘ডগেশ, ছো!’ চিৎকার করে উঠল ইভান। সঙ্গে সঙ্গে ছুটল ডগেশ। ভয়ে দ্রুত গিয়ার ফেলল জিকো। হালকা লাফ দিয়ে সামনে এগোল বাইক। হুংকার দিয়ে বাইকের পেছন পেছন ছুটল ডগেশ। বাঁ পা দিয়ে লাথি মেরে ওকে তাড়ানোর চেষ্টা করল জিকো। লাভ হলো না। বাইকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে কুকুরটা। ওকে এড়াতে গতি আরও বাড়ল বাইকের। তাতেই ঘটল বিপত্তি। মোড় ঘুরতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারাল জিকো। কষে ব্রেক চাপল। কিন্তু পিছলে গেল বাইকের চাকা। বাঁ পাশে কাত হয়ে ছেঁচড়ে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়ল বাইক। ওঠার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল জিকো। ওর শরীরের ওপরই পড়েছে বাইকটা। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে ডগেশ। তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ শুনতে পেল জিকো। ঘেউ ঘেউ করতে করতে পেছনে ফিরে গেল কুকুরটা। জিকো দেখল, আশপাশের দোকান থেকে দু-একজন ছুটে আসছে ওর দিকে। ‘আরে ভাই, একটু তাড়াতাড়ি আসেন না।’ চিৎকার করে বলল ও। উঁচু করে রাখা মাথাটা এলিয়ে দিল রাস্তায়। ওপরে তাকিয়ে ওর মনে হলো আকাশটা ডানে বাঁয়ে দুলছে।
বাসায় ফিরে কোনো কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে গেল ইভান। শাওয়ার ছেড়ে গোসল করে নিল ভালোমতো। গোসল শেষ করে ফোন নিয়ে বসল বিছানায়। বাবা কল করেছিল কয়েকবার। সাড়া না পেয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজ প্লে করল ইভান। ‘কী ব্যাপার, খুব বিজি মনে হচ্ছে? কেমন আছিস? তোর ছুটি তো শেষ শুনলাম। কাল থেকে স্কুলে যেতে হবে। যাবি না? নাকি আরও ছুটি কাটাবি?’ হাসল ইভান। ‘আর ছুটি লাগবে না বাবা। কাল স্কুলে যাব। আজকে আসলেই বিজি ছিলাম। আমার একটা কুকুরকে নিয়ে ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে শুনি ফুফা আমার বিড়ালটাকে বাইরে ফেলে দিয়েছে। ওটাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। পেলাম না। সব মিলিয়ে মনটা ভালো না। তুমি কেমন আছ জানিয়ো। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। টায়ার্ড লাগছে। সকালে স্কুলও আছে। কাল কল দিয়ো।’
কিছুক্ষণ পর খেতে ডাকলেন ফুফু। ইভান গিয়ে দেখল ফুফাও বসেছেন খেতে। তাঁর সঙ্গে একই টেবিলে বসে খেতে ইচ্ছা করল না ওর। ইভান বলল, ‘ফুফু, আমি আমার ঘরে গিয়ে খাই?’
‘কেন? টেবিলে খেতে কী অসুবিধা?’ ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন ফুফা। ‘বসো এখানে।’
চেয়ার টানল ইভান। ওর মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে গেলেন ফুফু। বললেন, ‘থাক, তুই ঘরে গিয়ে খা। খবরদার, বিছানায় ফেলবি না।’
‘আচ্ছা।’
আবার চেয়ার ঠেলে দিল ইভান। খাবার নিল প্লেটে। ঘরে ঢোকার সময় শুনল, চাপা স্বরে ফুফা বলছেন, ‘তুমি কিন্তু ওকে বেশি লাই দিচ্ছ।’
রাগ লাগল ইভানের। এক বিন্দু অনুশোচনা নেই এই লোকটার মধ্যে। একটা বাচ্চা বিড়ালকে বাইরে ফেলে দিয়ে এসে কী সুন্দর পাতলা ডাল আর আলু-মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত মেখে খাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইভানও খেতে শুরু করল। খেতে খেতেই ঠিক করে ফেলল, একটা পোস্ট দিতে হবে ফেসবুকে। কী লিখবে সাজিয়ে নিল মাথায়। খাওয়া শেষ করে প্লেট, হাত-মুখ ধুয়েই ফোন নিয়ে বসে পড়ল বিছানায়।
শাঁই শাঁই করে ছুটল ব্যাটারিচালিত রিকশা। অপেক্ষাকৃত দ্রুতই পৌঁছে দিল ইভানকে। ভাড়া মিটিয়ে ঘুরতেই রুশার সামনে পড়ল ইভান। রুশাও রিকশা থেকে নামল।
মুঠোফোনে তোলা বিড়ালটার একটা ছবি পোস্ট করে লিখল, ‘ছোট্ট কিউট এই বিড়ালকে রেসকিউ করেছিলাম রাস্তা থেকে। আমি যে রকম আমার ফুফা-ফুফুর বাসায় থাকি, বিড়ালটাও থাকত আমার কাছে। এখন পর্যন্ত অসংখ্য বিড়াল রেসকিউ করেছি। কিন্তু এত শান্ত বিড়াল দেখেছি খুব কমই। আমার ফুফা বিড়াল পছন্দ করেন না। ফুফা-ফুফুকে লুকিয়েই আমার ঘরে রেখে দিয়েছিলাম ওকে। কেউ টেরও পায়নি। আজ সকালেই ফুফার নজরে পড়ে যায় বিড়াল। ভেবেছিলাম, অ্যাডপশনে দিয়ে দেব। যোগাযোগও করেছিল একজন। আজই নেওয়ার কথা ছিল তার। অথচ প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিড়ালটা নিতে আসেনি সে। গুরুতর আহত একটা কুকুরকে নিয়ে হাসপাতালে কাটিয়েছি পুরো বিকেল। ভুলেই গিয়েছিলাম বাসায় আছে বিড়ালটা। সন্ধ্যায় এসে শুনি, ফুফার নির্দেশে ওকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে। দারোয়ান তাকে সানবিম ফিলিংস্টেশনে থেমে থাকা একটা পিকআপে উঠিয়ে দিয়েছে। পিকআপটা কোন দিকে গেছে, জানি না। কিন্তু কোথাও না কোথাও তো থামবে পিকআপটা। তারা হয়তো ব্যাগের ভেতরে থাকা বিড়ালটাকে দেখবে। নামিয়ে রাখবে। যদি কেউ পেয়ে থাকেন ওকে, প্লিজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আর কিছু যদি না-ও পারেন, অন্তত আমার পোস্টটা শেয়ার করেন প্লিজ। বাচ্চা একটা বিড়াল, রাস্তায় থাকলে হয়তো বাঁচবেই না।’
নিজের প্রোফাইল থেকে পোস্ট দেওয়ার পর বেশ কিছু ক্যাট লাভার গ্রুপে লিংকটা শেয়ার করল ইভান। কিছুক্ষণ পরই টের পেল, অনেকেই শেয়ার করছে ওর পোস্ট। কমেন্টে আসা প্রশ্নগুলোর জবাব দিল অনেকক্ষণ। তারপর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল বাতি নিভিয়ে। চোখ দুটো বুজে আসামাত্র বেজে উঠল ফোনের রিংটোন। ঘুম ঘুম চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে নাম দেখল ইভান—রুশা।
ভ্রু কুঁচকে কলটা কেটে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল আবার। সারা দিন খবর নেই, বিপদ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন কল দিয়ে কী লাভ? কয়েক মিনিট পর আবারও রুশার কল। এবার কলটা কেটে দিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে ফেলল ইভান। সারা দিনের ক্লান্তিতে দুচোখে আসতে একটুও সময় নিল না ঘুম।
ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে রইল ইভান। বালিশের পাশে হাতড়ে খুঁজে নিল ফোন। চোখ খুলে তাকাতেই দেখতে পেল অনেকগুলো মিসড কল। রুশা ফোন করেছে অনেকবার। অপরিচিত নম্বরও আছে একটা। ইভান ঠিক করল, রুশাকে কলব্যাক করবে না। কল করল অপরিচিত নম্বরটাতেই। রিং হলো অনেকক্ষণ, রিসিভ করল না। হাতমুখ ধুয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল ও। স্কুলে যেতে হবে। ক্লাসের ছেলেরা ওকে দেখে কী বলবে, ভাবতেই ভাবতেই এগোল ডাইনিং রুমের দিকে। নাশতা তৈরিই আছে। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েই একটা রুটি তুলে নিল হাতে।
‘এটা আবার কী?’ চায়ের মগে চুমুক দিয়ে বললেন ফুফু। ‘বসে খা। গলায় আটকাবে তো।’
‘সময় নাই ফুফু।’ দুই কামড়ে একটা ডিম পোচ পেটে চালান করে দিয়ে বলল ইভান। ‘দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই।’
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে জুতা-মোজা পরে ঝড়ের বেগে ছুটল ইভান। দেরি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না। সাধারণত হেঁটেই স্কুলে যেতে পছন্দ করে ও, কিন্তু আজ রিকশা নিল।
শাঁই শাঁই করে ছুটল ব্যাটারিচালিত রিকশা। অপেক্ষাকৃত দ্রুতই পৌঁছে দিল ইভানকে। ভাড়া মিটিয়ে ঘুরতেই রুশার সামনে পড়ল ইভান। রুশাও রিকশা থেকে নামল।
‘আরে, তুমি!’
জবাব দিল না ইভান।
‘কী, তুমি আমার কল ধরলা না কেন? কতবার তোমাকে কল দিয়েছি, জানো?’
‘আমিও তো তোমাকে কল দিয়েছি গতকাল। ধরো নাই। তুমি বললা, বিড়াল নিবা। তারপর আর খবর নাই। কল ধরো নাই, ব্যাকও করো নাই। মাঝখান দিয়ে বিড়ালটা গেল হারিয়ে।’
‘আমি তোমার পোস্ট দেখেছি। দেখেই সঙ্গে সঙ্গে কল দিয়েছি রাতে। আমি খুবই সরি।’
‘সরি বললেই হয়ে গেল? বললা না হয় সরি। বিড়ালটা তো আর পাব না।’
‘আমি…’
রুশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চলে গেল ইভান। কয়েক কদম এগোনোর পরই ওর মনে হলো, একটু বেশি কড়া হয়ে গেছে আচরণটা। এতটা না করলেও পারত। কিন্তু হুট করে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। একবার ভাবল, ঘুরে গিয়ে সরি বলে আসবে। পরক্ষণেই মনে হলো, দরকার নেই। শুরু থেকেই ঝামেলা করছে মেয়েটা।
ক্লাসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হইচই করে ঘিরে ধরল ইভানকে। মন ভালো হয়ে গেল ওর। অনেকেই ওকে টেনে বসাতে চাইল নিজের পাশে। বসল না ইভান। চলে গেল নিজের পছন্দের জায়গায়—শেষ বেঞ্চের ঠিক আগের বেঞ্চটায়। রাহাতের পাশে ব্যাগ রেখে চলে এল সামনে। অ্যাসেম্বলিতে যেতে হবে। হইচই করতে করতে অ্যাসেম্বলিতে চলে গেল ওরা।
অ্যাসেম্বলি শেষ করে ক্লাসে ফিরে এল ইভান। বেঞ্চে বসার পর রাহাত বলল, ‘স্যার আসার আগেই ব্যাগটা চেক করে দেখ। ছুরি-চাপাতি আছে কি না।’
হেসে ফেলল ইভান। ব্যাগ খুলে একবার চেক করে দেখল ফোনটা, সাইলেন্ট করা আছে। এসএমএসও এসেছে দেখি। ব্যাগের ভেতরে ফোন রেখেই দেখল এসএমএস—রুশা পাঠিয়েছে। ‘সরি। আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম। প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। ওষুধ খেয়ে বেহুঁশের মতো শুয়ে ছিলাম, তাই কল ধরতে পারিনি। চিন্তা কোরো না, বিড়ালটাকে পাওয়া যাবে।’
রুশার এসএমএস পড়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো ইভানের। না জেনেই ওকে জাজ করে ফেলা একেবারেই ঠিক হয়নি। নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হলো ও।
‘কিরে, কী হয়েছে?’
‘কিছু না। বিড়ালটা মনে হয় পাব না রে।’
‘তোর পোস্ট তো ফেসবুকে ভাইরাল। আমার মনে হয় পেয়ে যাবি।’
‘আরে না। ফেসবুক পোস্টে কোনো কাজ হয় না। আগেও দেখেছি। আচ্ছা শোন, গতকাল তো একটা কাহিনি হয়েছে। বাসায় ফেরার সময় জিকো এসেছিল। মারতে গিয়েছিল আমাকে। তখন ডগেশকে দিয়ে ওকে তাড়া করিয়েছি। বাইক নিয়ে পিছলে পড়ে গেছে ব্যাটা।’
‘সেই! একদম উচিত শিক্ষা হয়েছে ওর।’
ঠিক তখনই উঠে দাঁড়াল সবাই। ক্লাসে ঢুকেছেন জমিরউদ্দিন স্যার। লেকচার টেবিলের ওপর খাতা রেখে রোলকল করার আগেই স্যারের চোখ পড়ল ইভানের দিকে। কিছু না বলে মুচকি হাসলেন স্যার। তারপর শুরু করলেন রোলকল। ‘রোল নম্বর ১…’
বারবারই ইভানের মন হচ্ছিল রুশাকে একটা রিপ্লাই দেওয়া উচিত। কিন্তু বুঝতে পারছিল না কী লিখবে। টিফিনের সময় আবার বের করল ফোনটা। লক খুলতেই দেখল সেই অপরিচিত নম্বর থেকে দুটো মিসড কল। সঙ্গে সঙ্গে কলব্যাক করল ইভান।
‘হ্যালো…’
‘আরে ভাই, আপনাকে তো ফোনেই পাই না।’
‘কে বলছেন?’
‘আমি রতন। আপনার নাম ইবান না?’
‘ইভান।’
‘তো ইবান ভাই, আপনার বিড়াল তো পাইসি। এসে নিয়ে যান।’
‘সত্যি! কোথায় পেলেন?’
‘ভাই, এই বিড়ালের জন্য যা করল আপনার বন্ধু!’
‘আমার বন্ধু কী করল? কোন বন্ধু?’
‘আরে ভাই, এত কথা বলার সময় নাই। আপনি উত্তরা আসেন। ১৮ নম্বর সেক্টর। আইসা আপনার বিড়াল নিয়ে যান।’
‘বললেই হয় নাকি…আমি তো এখন স্কুলে…ছুটির পর আসতে পারব। আর আপনি হোয়াটসঅ্যাপে বিড়ালটার ছবি পাঠান তো। দেখি, আমার বিড়াল কিনা।’
‘ভাই, কথা কইলে বিশ্বাস করেন না। আমি ছবি পাঠাইতেসি। আপনি সন্ধ্যার আগে আইসা বিড়াল নিয়া যাইয়েন। আমরা বিল্ডিংয়ে টাইলসের কাজ করি। সন্ধ্যার পর কেউ থাকে না। এই বিড়াল পরে অন্য কোথাও চইলা গেলে পরে আমরা আবার পুলিশের ঝামেলায় পড়ব।’
‘আচ্ছা। আপনি ছবি আর ঠিকানা পাঠান। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আসছি।’
ছবি চলে এল কয়েক মিনিট পরেই। উত্তেজিত হয়ে উঠল ইভান। ‘আরে, এ তো আমরই বিড়াল!’ ইভানের কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে দেখল রাহাত। ‘তাই তো। বলেছিলাম না, পাবি। যে আবেগঘন পোস্ট লিখেছিস ফেসবুকে।’
‘আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। ওয়েট…’
‘কী?’
‘লোকটা কেন বলল, পুলিশের ঝামেলায় পড়বে? এর মধ্যে পুলিশের কথা এল কেন?’
‘এত কথা ভেবে লাভ আছে? ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। চল।’
‘ছুটির পর উত্তরা যেতে হবে, মামা।’
‘আমি পারব না, মামা। আজকে কোচিংয়ে না গেলে বাসায় আমার কবর রচিত হবে। কালকেও যাই নাই।’
‘তা-ও ঠিক। আচ্ছা আমিই যাব। প্যারা নাই।’
ক্লাস শুরু হতেই বিষয়টা বুঝতে পারল ইভান। লোকটা বলছিল, বন্ধু অনেক কিছু করেছে। এই বন্ধু আর কেউ নয়—রুশা। রুশার বাবা যে পুলিশের কর্মকর্তা, মাথায়ই ছিল না। এ জন্যই লোকটা পুলিশের কথা বলেছে। রুশাই খুঁজে বের করেছে বিড়ালটাকে। কীভাবে? ক্লাসের মধ্যেই লুকিয়ে রুশাকে এসএমএস পাঠাল ইভান, ‘বিড়ালটা পাওয়া গেছে। ছুটির পর আনতে যাব। তুমি যাবা?’
‘যাব।’ জবাব এল এক পিরিয়ড পর। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ইভান।
ছুটির পর রিকশা নিয়ে দ্রুত মেট্রোস্টেশনে চলে এল ইভান আর রুশা। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর গত রাতে যে কত কিছু হয়ে গেছে, জানে না ইভান। মেট্রোতে উঠে সব বলল রুশা।
‘তোমার পোস্ট দেখে বাবার এক কলিগকে কল করলাম। উনি ওই ফিলিং স্টেশনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে পিকআপটাকে খুঁজে বের করলেন। তারপর বহু কষ্টে বের করলে সেই পিকআপ ড্রাইভারকে। ড্রাইভার তো জানেই না যে তার পিকআপে বিড়াল আছে। তারা টাইলস নিয়ে উত্তরা গিয়ে পৌঁছেছে, তখনো নামানো শুরু করেনি। নামাতে গিয়ে দেখে…টাডা, ব্যাগের ভেতর বিড়াল। আমাকে রাতেই জানিয়েছিল, কিন্তু তুমি তো রাগ দেখিয়ে কল রিসিভ করো নাই।’
‘সরি।’
‘সরি বললেই হয়ে গেল?’
হেসে ফেলল ওরা। মেট্রো থেকে নেমে ঠিকানায় পৌঁছতে ১০ মিনিটও লাগল না। টাইলসের একটা বাক্সে বিড়ালটাকে বসিয়ে রেখেছে লোকগুলো। একটা বাটিতে দুধও খেতে দিয়েছে। ‘খুব লক্ষ্মী বিড়াল। সব বোঝে।’ বলল রতন নামের লোকটা।
‘উচ্চশিক্ষিত।’ বলল রুশা।
হাসল সবাই। সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বিড়ালটাকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল ওরা। বাসে উঠে পড়ল দ্রুত। বিড়ালটাকে নিজের কোলে নিয়ে বসে রইল রুশা।
‘কিরে, এত দিন আমার কাছে থাকলি, এখন দেখি চিনতেই পারছিস না।’ বলল ইভান।
এমন সময় বেজে উঠল ইভানের ফোন। রাহাত কল করেছে।
‘হ্যালো, রাহাত, বল।’
‘বিড়াল পেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ। এলাকায় আসছি বাসে।’
‘শোন, জিকো তো হাসপাতালে।’
‘ও। কী হয়েছে?’
‘গত রাতে যে পড়ে গেল তোদের ওই দিকে, ওর তো পা ভেঙে গেছে।’
‘আয় হায়!’
‘নেমে কল দিস।’
মন খারাপ হয়ে গেল ইভানের। ‘এটা আমি কী করলাম!’ ভাবল ও। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করল রুশা। জবাবে শুনল, ‘কিছু না’। অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে রইল ও।
বাস থেকে নেমে বিড়াল নিয়ে বাসায় চলে গেল রুশা। ইভানও চলে গেল নিজের বাসায়। হাত–মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে কল দিল রাহাতকে। শুনল, বাজেভাবে ফ্র্যাকচার হয়েছে জিকোর। হাঁটতে পারবে না অনেক দিন। মন খারাপ হয়ে গেল ইভানের। ব্যাপারটা এ রকম হবে, কল্পনাও করেনি ও। বাতি নিভিয়ে শুয়ে থাকল অনেকক্ষণ। ফুফু এসে ডেকে গেলেন কয়েকবার, উঠল না। অনেক রাতে ফোন বেজে উঠল ওর। রুশা ফোন করেছে। কল ধরল ইভান।
‘হ্যাঁ, রুশা, বলো।’
‘ইভান, তুমি জানতা, তাই না?’
‘কী জানতাম?’
‘বিড়ালটা যে নরমাল বিড়াল না?’
‘নরমাল বিড়াল না মানে? কী বলো?’
‘তুমি জানতা না?’
‘আরে কী অদ্ভুত। তোমার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘মানে, তুমি জানতা না যে বিড়ালটা কথা বলতে পারে?’
‘বিড়াল কি টিয়াপাখি নাকি যে কথা বলবে?’
‘ইভান! আমি নিজের কানে শুনেছি। এটা কোনো নরমাল বিড়াল না। এই বিড়াল স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে।’
‘ও মাই গড!’
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619