‘কিরে, ইভান, এরা কী বলছে? তুই ফোন নিয়েছিস?’ জিজ্ঞেস করলেন ফুফু।
‘হ্যাঁ, নিয়েছি,’ জবাব দিল ইভান। ‘কিন্তু ওনারা যেটা বলছেন, সেটা ঠিক নয়। ফোন চুরি করিনি আমি। জিকো রাখতে দিয়েছে আমার কাছে।’
‘জিকোর সঙ্গে মিশিশ তুই?’
‘রাখতে দিয়েছে, তাই না? ফাজলামো হচ্ছে? সবাই এ রকম কথাই বলে।’ ব্যাঙ্গ করে বললেন একজন পুলিশ সদস্য। ‘ফোনটা কোথায়?’
‘আমার কাছেই আছে। দাঁড়ান, নিয়ে আসছি।’
‘তোমার আনতে হবে না। আমরা খুঁজে দেখব। আর কয়টা ফোন নিয়েছ দেখতে হবে আমাদের।’
‘না না, থাক।’ পুলিশ সদস্যকে বাধা দিলেন জিকোর মামা। ‘ওকেই নিয়ে আসতে দিন। যাও বাবা, ফোনটা নিয়ে এসো।’
রাগে, অপমানে হাত-পা কাঁপছে ইভানের। কান দুটো গরম হয়ে গেছে, টের পাচ্ছে ও। ঘেমে উঠেছে হাতের তালু। নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে ভেতরে ভেতরে। বড় করে শ্বাস নিয়ে ঘরের দিকে এগোল ইভান। শুনতে পেল, ফুফা-ফুফু অস্থির হয়ে বসতে বলছেন পুলিশ আর জিকোর মামাকে। ‘আপনারা ভুল করছেন। ও এ রকম ছেলেই নয়,’ ফুফাকে বলতে শুনল ইভান। চোখে পানি চলে আসছিল ইভানের। কীভাবে সেটা আটকাল, তা ও নিজেও জানে না। ড্রয়ার খুলে ফোনটা বের করল ইভান। আছাড় মেরে ফোনটা টুকরা টুকরা করে ফেলতে ইচ্ছা করছিল ওর। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল ফোনটার দিকে। তারপর পা বাড়াল ড্রইংরুমের উদ্দেশে। ‘আবার কি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ?’ ভাবল ইভান।
ড্রইংরুমে এসে জিকোর মামার হাতে ফোনটা তুলে দিল ইভান। কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
‘ফোনটা আমি নিতে চাইনি। জিকোই আমাকে রাখতে দিয়েছিল। আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিকোকে জিজ্ঞেস করবেন প্লিজ।’
‘এই ফোনটা আমার।’ গম্ভীর স্বরে বললেন জিকোর মামা। ‘আমার ফোন কেন তোমার কাছে রাখতে দেবে জিকো?’
‘এই ছেলে মিথ্যা কথা বলতেসে, বোঝেন নাই?’ পান চিবোতে চিবোতে বললেন একজন পুলিশ সদস্য। ‘এদের আমরা খুব ভালোভাবে চিনি। ফোন বিক্রি করে নেশা করে।’
‘ছি ছি! এসব কী উল্টাপাল্টা বলছেন আপনার?’ রেগে গেলেন ফুফা। ‘ইভানেরই ভালো ফোন আছে। অন্যের ফোন নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর আপনারা ভালোভাবে খোঁজখবর নিন। স্কুলে যান, প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করুন। কোনো খারাপ রেকর্ড পাবেন না ওর নামে। ওকে ফোন রাখতে দিয়েছে, ও রেখেছে। সিম্পল ব্যাপার।’
ফুফাকে এভাবে রেগে যেতে আগে কখনো দেখেনি ইভান। ও ভেবেছিল, উল্টো ওর ওপরই রেগে যাবেন ফুফা।
‘আপনাদের ছেলে, আপনারা তো বলবেনই এ রকম ভালো ভালো কথা,’ বললেন পুলিশ সদস্য।
‘দেখেন আঙ্কেল, আমি আর রাহাত শুধু জিকোকে দেখতে গিয়েছিলাম,’ বোঝানোর চেষ্টা করল ইভান। ‘ও তো শুরুতেই আমাদের দেখে খেপে গেল। আপনি তো ছিলেন, নিজেই দেখেছেন। আপনি বের হওয়ার পর জিকো হুট করে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন আমরা অবাক হয়েছি, কিন্তু অন্য কিছু মাথায় আসেনি। এখন মনে হচ্ছে, পুরোটাই ওর সাজানো।’
‘কেন এ রকম করবে ও?’ মানতেই চাইলেন না জিকোর মামা, ‘পা ভেঙে হাসপাতালে শুয়ে আছে ছেলেটা। ওর মাথায় এসব আসারই কথা নয়।’
‘জিকো আমাকে বলেছে, ওর দুটো ফোনই আপনারা নিয়ে নিয়েছেন। এটা ওর বাড়তি ফোন। এটা যেন আমি লুকিয়ে রাখি। ও চাইলে আবার নিয়ে যাব। ও যে আমাকে ফোন রাখতে দিয়েছে, এটা রাহাতও জানে। আপনারা রাহাতকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি ওকে কল দিই, লাউডস্পিকারে আপনারা কথা বলে দেখেন।’
‘আমি কথা বলব কেন? আমার ফোন চুরি গেছে। আমি ফোন পেয়েছি। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।’ জিকোর মামা উঠে দাঁড়ালেন, ‘তোমার বয়স কম, জিকোর বন্ধু তুমি। আমি চাই না, তুমি থানা–পুলিশের ঝামেলায় পড়ো। তবে, ভবিষ্যতে এ রকম কাজ যেন আর না করো, সেটার জন্য যা করা দরকার, আমি করব।’ সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ফুফা–ফুফুর দিকে ঘুরলেন জিকোর মামা, ‘আর আপনাদের বলছি, ছেলের দিকে খেয়াল রাখা উচিত আপনাদের। নইলে তো ছেলে মানুষ হবে না। আজ চুরি করছে, কাল করবে ডাকাতি। পরশু খুন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি ছেলেপেলেকে ভালো শিক্ষা দিতে না পারেন, তাহলে তো বিপদ। আপনারা ভদ্রলোক, আমি আর এখন কোনো অ্যাকশনে গেলাম না। চাইলে আমি ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতাম, বুঝতেই পারছেন। কিন্তু এ যাত্রায় আমি ওকে একটা সুযোগ দিলাম। ঠিক আছে? আসি তাহলে।’
দরজা খোলাই ছিল, গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন জিকোর মামা। পেছন পেছন বেরিয়ে গেল দুই পুলিশ। তাঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পরের কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না কেউ। শুধু ফ্যান ঘোরার শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ইভান। কী করবে, বুঝতে পারল না ও। ফুফুর ফোঁপানির শব্দ আরও বাড়িয়ে তুলল অস্বস্তিকর নীরবতা। চোখ মুছতে মুছতে দরজা বন্ধ করতে এগোলেন ফুফু। সশব্দ দরজা বন্ধ করে ধপ করে বসে পড়লেন সোফায়। ‘আর কত যন্ত্রণা দিবি আমাদের?’ কাঁদতে কাঁদতে বললেন ফুফু, ‘যা–তা বলে অপমান করে গেল।’
স্কুলে আসার পরই ইভান টের পেল, কয়েকজন একটু অন্য রকম আচরণ করছে। পাত্তা দিল না ও। সাধারণত শেষ বেঞ্চের আগের বেঞ্চটায় বসে ইভান। সেখানেই কোনার দিকে রাখল ব্যাগ। একটু পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল রাহাত। হাঁপাতে হাঁপাতে ইভানকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, তুই ঠিক আছিস?’
‘আমি খুবই সরি ফুফু। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ফোন চুরি করিনি। জিকো আমাকে ফাঁদে ফেলেছে,’ মাথা নিচু করে বলল ইভান।
‘কেন তুই ওর কাছে যাবি? এত কিসের বন্ধুত্ব ওর সঙ্গে? আজেবাজে ছেলের সঙ্গে কেন মিশবি তুই? ফোন দিল আর নিয়ে নিবি? ও যদি তোকে পিস্তল দিত, নিয়ে আসতি?’
চুপ করে রইল ইভান।
‘থাক, ভুল করে ফেলেছে, এখন আর কিছু করার নেই। যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো। ইভান, তুমিও শুতে যাও।’
‘সরি, এ রকম আর হবে না।’ বলেই ঘুরল ইভান। দ্রুত চলে এল নিজের ঘরে। ধপ করে বসে পড়ল খাটের ওপর। হাঁটুর ওপর কনুইয়ে ভর দিয়ে দুহাতে চোখ ঢেকে বসে রইল অনেকক্ষণ। এভাবে বোকা বনে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই।
রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারল না ইভান। এপাশ–ওপাশ করল বিছানায়। বারবারই ওর মনে পড়ছে জিকোর কথা। ওকে অপদস্থ করতে পেরে কী আনন্দই না পাচ্ছে জিকো! নিশ্চয়ই নিজেদের গ্রুপগুলোয় ইভানকে নিয়ে মজা করছে ওরা। ব্যাপারটা কোনোভাবেই স্থির হতে দিচ্ছে না ইভানকে। রাতটা যেন শেষই হতে চাইছে না। ক্লান্তিতে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য একটু চোখ বুজে এসেছিল, সেটাকে ঘুম বলা যাবে না। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দে ধরমর করে জেগে উঠেছে ইভান। বাইরে ঝুমবৃষ্টি। জানালার পর্দা সরাতেই বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ল ওর চোখে–মুখে। সকাল হলেও কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে আছে চারপাশ। কিছুক্ষণ বসে বৃষ্টি দেখল ইভান। এত সুন্দর একটা সকালও ওর মন ভালো করতে পারছে না। উঠে গিয়ে একগ্লাস পানি খেল। এদিক–ওদিক পায়চারি করল কিছুক্ষণ, ভালো লাগল না তবু। ইভানের মনে হলো, ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজলে ভালো লাগবে। ভাবনাটা বাস্তবায়ন করতে ওর সময় লাগল কয়েক সেকেন্ড! দরজা খুলে একদৌড়ে চলে এল ছাদে। বৃষ্টির তীব্রতা এত বেশি যে কয়েক মিনিটেই ভিজে চুপসে গেল ইভান। ওর মনে হলো, ঝুমবৃষ্টি অসংখ্য পানির ফুল তৈরি করছে ছাদে। ফুলগুলো ফুটেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঠান্ডা বাতাসে একটু পরপরই কেঁপে উঠছে ইভান। কাঁপতে কাঁপতেই ওর মনে হলো, ফেসবুকের একটা পোস্টের কারণেই আজ এত কিছু। সায়েন্স ফেস্টের বাজেট থেকে যে টাকা মেরে দিয়েছিল জিকোরা, কেউ কথা বলেনি সেটা নিয়ে। স্কুলে তো আরও হাজার হাজার শিক্ষার্থী আছে। সবাই জানে এই দুর্নীতির কথা। কোনো উৎসব হলেই সিনিয়ররা বাজেট এদিক–সেদিক করবে, এটা এখন খোলামেলা বিষয় ওদের স্কুলে। শিক্ষকেরাও জানেন সেটা, বলেন না কিছু। কে চাইবে সিনিয়রদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে? কিন্তু ইভান সেটা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বসল। সেটার জের ধরে যে এত কিছু হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করেনি ও। অথচ ঠিকই তক্কে তক্কে ছিল জিকো। সুযোগ বুঝে ইভানকে এমনভাবে ফাঁদে ফেলল যে বের হতে গিয়েও বারবার আটকে যাচ্ছে সে। নাহ, ওর সঙ্গে ঝামেলায় যাওয়াটা ঠিক হয়নি, ভাবল ও। পরক্ষণেই মনে হলো, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। এটার শেষ দেখে ছাড়ব আমি। ওকে এমন শিক্ষা দেব যে কোনো দিন আর আমার সঙ্গে লাগতে আসবে না। একটা কাক এসে ‘কা কা’ স্বরে ডেকে চমকে দিল ইভানকে। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। কাঁপতে কাঁপতে নিচে নেমে এল ইভান। গোসল করে রেডি হতে হবে তাড়াতাড়ি। স্কুল আছে আজ।
স্কুলে আসার পরই ইভান টের পেল, কয়েকজন একটু অন্য রকম আচরণ করছে। পাত্তা দিল না ও। সাধারণত শেষ বেঞ্চের আগের বেঞ্চটায় বসে ইভান। সেখানেই কোনার দিকে রাখল ব্যাগ। একটু পর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল রাহাত। হাঁপাতে হাঁপাতে ইভানকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে, তুই ঠিক আছিস?’
‘হ্যাঁ।’ অবাক হলো ইভান। ‘কেন? কী হয়েছে?’
‘জানিস না তুই?’
‘কী?’
‘তোকে নিয়ে তো গ্রুপে গ্রুপে ট্রল হচ্ছে। মিম বানিয়েছে।’
‘মানে!’
‘নিচে চল তাড়াতাড়ি।’
হাত ধরে ইভানকে প্রায় টেনে নিয়ে গেল রাহাত। সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত নিচে নেমে এল ওরা। স্কুলের পাশে একটা খোলা জায়গা আছে, মাঝেমধ্যে টিফিনের সময় টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলে ওরা এখানে। সেখানে এসে পকেট থেকে ফোন বের করল রাহাত। গ্যালারি ঘেঁটে বের করল একটা মিম। ওপরে একটা আইফোনের ছবি। পাশে লেখা ‘iphone’। নিচে ইভানের প্রোফাইল পিকচার থেকে নেওয়া একটা ছবি। পাশে লেখা ‘ithief’। দেখে মাথাটা ঘুরে উঠল ইভানের। ‘এসব কী!’
‘জিকোর পোলাপান এগুলো গ্রুপে গ্রুপে ছড়িয়েছে। কী হয়েছে বল তো!’
গত রাতে যা যা ঘটেছে, রাহাতকে বলল ইভান। শুনে প্রচণ্ড খেপে গেল ও।
‘ধুর ব্যাটা! আমি জানতাম, এ রকম কিছু ঘটবে। কোন আক্কেলে যে তুই ওর ফোনটা নিতে গেলি! হাসপাতালে গিয়ে শয়তানটার আরেকটা ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে আসতে হবে।’
‘সবাই দেখেছে এই মিম?’
‘এখনো সবাই দেখেনি, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। সবাই দেখে ফেলবে।’
‘কী করব এখন?’
‘চুপ করে থাকবি। কোনো উত্তর দিবি না। আর দেখবি, কে কে এগুলো নিয়ে মজা নিচ্ছে। এদের থেকে পরে সাবধান হয়ে যেতে হবে।’
‘আচ্ছা।’
‘চিন্তা করিস না, দোস্ত। এই সব কোনো ব্যাপার না। চল, অ্যাসেম্বলিতে যাই।’
অ্যাসেম্বলিতে পেছনের দিকে দাঁড়াল ইভান। পিটি স্যারের কোনো কথাই আজ কানে ঢুকল না ওর। পেছনের বন্ধু পিঠে খোঁচা না দিলে বোধ হয় অ্যাসেম্বলি শেষ হওয়ার পরও দাঁড়িয়ে থাকত অনেকক্ষণ। লাইন ধরেই স্কুলের দিকে এগোচ্ছিল ইভান। হঠাৎ দপ্তরি জাকির এসে বললেন, ‘আপনারে হেডস্যার ডাকে।’ থমকে দাঁড়াল ইভান। ওকে পাশ কাটিয়েই বাকিরা ঢুকে পড়ল স্কুল ভবনে। লাইনের মাঝখান থেকে যত দূর সম্ভব ওর দিকে তাকিয়ে রইল রাহাত।
অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে আবার প্রধান শিক্ষকের রুমে আসতে হলো ইভানকে। রুমে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল ও। চিন্তিত মুখে চেয়ারে বসে আছেন ফুফা।
‘ফুফা, আপনি!’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘স্কুল থেকে ফোন করেছিল। বলল জরুরি। তোমার ফুফুর শরীরটা খারাপ, তাই এলাম।’
হেডস্যার এখনো আসেননি রুমে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ইভান। ফ্যানের বাতাসে প্লাস্টিকের টেবিল ক্লথটা কাঁপছে। সেদিকে তাকিয়ে রইল ও। একটু পর রুমে ঢুকলেন প্রধান শিক্ষক। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম দিলেন ফুফা। ইশারায় তাঁকে বসতে বললেন স্যার।
‘চা দিয়ো এখানে,’ গলা উঁচিয়ে আদেশ দিলেন প্রধান শিক্ষক। তারপর ইভানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফুফাকে বললেন, ‘সরি, সকাল সকাল আপনাকে কষ্ট দিলাম।’
‘না, ঠিক আছে। সমস্যা নেই।’ ফুফা বললেন।
‘দেখুন, আমার স্কুলে আমি শৃঙ্খলাকে খুব গুরুত্ব দিই। স্কুলের একটা সুনাম আছে। আমি সব সময় ছাত্রদের ভালো চাই। গত কয়েক সপ্তাহে ইভান যেসব ঘটনার সঙ্গে জড়িয়েছে, আমরা ওর পাশে ছিলাম।’
‘জি।’
‘ভাই, আপনার ভাগ্য ভালো, ওনারা কেস-টেস করেননি। অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আর এটা ইভানের জন্য ভালোই হবে। এখানে থাকলে সবাই ওর দিকে অন্যভাবে তাকাবেই।’
‘কিন্তু এবার ও যা করেছে, এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাসপাতালে গিয়ে কাউন্সিলর সাহেবের আত্মীয়ের মোবাইল চুরি! ভয়ংকর অভিযোগ।’
‘আমি চুরি করিনি স্যার।’ পাশ থেকে বলল ইভান।
‘তুমি চুপ থাকো!’ ধমক দিলেন প্রধান শিক্ষক। ‘সে যা–ই হোক, আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করান। আমরা এখানে ওকে রাখতে পারছি না।’
‘এটা কী বলছেন স্যার? কদিন পর ওদের এসএসসি। ওর ভবিষ্যৎটা নষ্ট হয়ে যাবে স্যার।’
‘ওর ভালোর জন্যই বলছি। ম্যানেজমেন্টও চাচ্ছে না। কাউন্সিলর টিটু সাহেব স্কুল কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি। রাতেই উনি আমাকে কল দিয়েছিলেন। এমনিতেই নানা রকম চাপে আছি আমরা। এই চাপ ভাই আর নিতে পারছি না।’
‘আশ্চর্য কথা! আপনারা এভাবে একটা নির্দোষ ছেলেকে বের করে দেবেন? এটা কেমন কথা?’
‘ভাই, আপনার ভাগ্য ভালো, ওনারা কেস-টেস করেননি। অল্পের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আর এটা ইভানের জন্য ভালোই হবে। এখানে থাকলে সবাই ওর দিকে অন্যভাবে তাকাবেই।’
‘সেটা তো অন্যদের সমস্যা, তাই না?’ রেগে গেলেন ফুফা। ‘ওর অপরাধটা কী? পুরো ব্যাপারটা যে সাজানো, এটা আপনি বুঝতে পারছেন না? মানে এটা কোনো কথা হলো? আপনি তদন্ত করেন, সবাইকে ডাকেন। কমিটি করেন। কোনো রকম বিচার–বিশ্লেষণ ছাড়া একটা ছেলেকে বের করে দেবেন, এটা তো ঠিক নয় স্যার। একটু ভেবে দেখুন ব্যাপারটা। আপনি তো ওকে চেনেন।’
‘ভাই, বোঝার চেষ্টা করুন। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের আত্মীয়ের ফোন পাওয়া গেছে ইভানের কাছে। এটা কত বড় ঘটনা, আপনি চিন্তা করতে পারেন? আপনার–আমার আত্মীয় নয় যে দুপুরে পোলাও–রোস্ট খাইয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেললাম। স্বয়ং কাউন্সিলরের আত্মীয়। উনি নিজে ফোন করে আমাকে বলেছেন বিষয়টা দেখতে। আমার কিছু করার নেই। ছেলেকে নিয়ে যান। টিসি তৈরি হলে আপনাকে আবার ডাকব।’
‘স্যার…প্লিজ…স্যার…আমার একটা অনুরোধ রাখেন স্যার! মা মরা ছেলে স্যার। ওর বাবা আমার হাতে ছেলেটাকে রেখে গেছে। আমি তাকে কী জবাব দেব? একটু দেখেন স্যার, প্লিজ।’ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে প্রধান শিক্ষকের হাত ধরে অনুরোধ করতে লাগলেন ফুফা। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হলো ইভানের। খুব বলতে ইচ্ছা করল, ‘ফুফা, চলে আসেন। এই স্কুলে আমি আর পড়ব না’, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হলো না। এমন কি হতে পারে না যে পুরো ব্যাপারটাই একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন? ঘুম ভাঙলেই দেখবে শুয়ে আছে ওর বিছানায়…
‘ইভান, চলো।’
ফুফার কথায় চমকে উঠল ইভান। হাঁটা শুরু করেছেন তিনি, বেরিয়ে যাচ্ছেন প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে। পেছন পেছন হেঁটে এলেন প্রধান শিক্ষকও। সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল ইভান। প্রধান শিক্ষক থামালেন ওকে।
‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?’
‘ক্লাসে স্যার, আমার ব্যাগ…’
‘তোমার ব্যাগ জাকির নিয়ে এসেছে। ওই যে, ওখানে আছে।’
ইভান তাকিয়ে দেখল, সিঁড়ি পাশেই ওর ব্যাগ রাখা। নিচু হয়ে ব্যাগ তুলে নিয়েই ফুফার পেছনে হাঁটতে শুরু করল ও। ইভান জানে না, চিরচেনা এই স্কুলে আবার ফিরে আসবে কি না।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619