দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি
‘আচ্ছা দোস্ত, ওই মেয়েটার কেসটা কী রে?’ হাঁটতে হাঁটতে ইভানকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল রাহাত। ফুটপাথ ধরে হেঁটে হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে ওরা। রাহাত অবশ্য যেতে চাচ্ছিল না। ইভানের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত যেতে বাধ্য হয়েেছ ও। শর্ত একটাই—সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে বাসায়। ইভান যদিও বলেছে, ‘জাস্ট দেখা করেই চলে আসব’, কিন্তু রাহাত জানে, কোনো না কোনো ঝামেলা হবেই ওখানে গেলে। হাসপাতালে ওদেরকে দেখে নিশ্চয়ই খুশিতে বাকবাকুম হয়ে উঠবে না জিকো। পা ভেঙে যেহেতু শুয়ে আছে, মারামারি তো আর হবে না, তারপরও নিশ্চিত হতে পারছে না রাহাত। তবে কয়েকজনের কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়েই যাচ্ছে ওরা। জিকো নাকি অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গেছে। ইভানও কেন যেন কোনো কথা বলছে না। প্রশ্নটা করে ভুল করল কিনা ভাবছে রাহাত । দুপুরে এতগুলো গোল খেয়ে হয়তো মন মেজাজ ভালো নেই ইভানের। রোদের তেজ কমার পরই বেরিয়েছে ওরা। দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি এ সময়টায় রাস্তায় তেমন ভিড় থাকে না। ইভানের মনে হয়, পুরো পাড়াকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখে কেউ। কিছু দোকানের শাটার নামানো। চায়ের দোকানগুলোতে লোকজন নেই। দোকানের ভেতরে টুলে বসে পা নাচাচ্ছেন অলস দোকানদার।
‘কিরে, উত্তর দিবি না?’ কনুই দিয়ে ইভানের কোমরে খোঁচা মারল রাহাত।
‘রুশার কথা জিজ্ঞেস করছিস?’ পাল্টা প্রশ্ন করল ইভান।
‘হু।’
‘মেয়েটা অদ্ভুত। মাথায় ঘাপলা আছে মনে হয়।’
‘বিস্তারিত কমেন্টে টাইপ কথা বলিস না। পুরোটা বল।’
‘কী বলব…আমি নিজেই তো কেসটা বুঝতে পারছি না।’
‘তাহলে তো মামা এখানে অন্য কাহিনি আছে মনে হচ্ছে।’
‘আরে ধুর ব্যাটা। কোনো কাহিনি নাই। তবে মেয়েটা অদ্ভুত। মানে এ রকম অদ্ভুত মেয়ে আমি জীবনে দেখি নাই। আমাকে যেদিন ক্লাস থেকে বের করে দিল, আমি প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তখন ওর সঙ্গে দেখা।’
‘তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ, ও এসে বলল, প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে যে দুজন পুলিশ আছে, এরা নকল পুলিশ। ওকে কিডন্যাপ করতে এসেছে। আমি যেন ওকে স্কুল থেকে বের হতে হেল্প করি। আমি তো প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। পরে মনে হলো, সত্যি বলছে। তখন ওকে প্রাইমারি স্কুলের পেছনের ভাঙা দেয়াল টপকে পার করে দিলাম।’
‘ওরে বাপরে বাপ!’
‘তারপর শোন। আমাকে যখন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে, তখন পুলিশের কাছে একটা ফোন এল। কে ফোন করেছে জানিস?’
‘কে? তোর ফুফা?’
‘আরে ধুর গাধা। ফুফা তো তখন থানাতেই। ভয়ে পিঁপড়া হয়ে বসে আছে। কল দিয়েছে রুশা। কী বলেছে তা জানি না। কিন্তু আমাকে জিজ্ঞেস করল ওকে কীভাবে চিনি, কী কথা হয়েছে এই সব। তারপর তো আমাকে ছেড়ে দিল।’
‘হেভি পাওয়ারফুল তো মেয়েটা।’
‘যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, রুশা ওনার মেয়ে।’
‘হোয়াট!’
‘হ্যাঁ। তারপর আমি তো বিড়াল অ্যাডপশনের পোস্ট দিলাম। রুশা ফোন করে জানাল ও বিড়ালটা নিতে চায়। যেদিন নেওয়ার কথা, সেদিন ওর আর খবর নাই। তার পরের ঘটনা তো তুই জানিস। বিড়ালটা হারিয়ে গেল। তখন আবার পোস্ট দিলাম। রুশা ওর পুলিশ সোর্স খাটিয়ে বিড়ালটাকে খুঁজে বের করল। বিড়ালটা এখন ওর কাছে।’
‘এ তো খুবই ভালো মেয়ে। তুই কেন বলছিস মাথায় ঘাপলা?’
রুশা যে বলেছে বিড়াল কথা বলতে পারে, কথাটা এড়িয়ে গেল ইভান। ওর মনে হলো, নিশ্চিত না হয়ে এখনই রাহাতকে কিছু বলা ঠিক হবে না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে ইভান বলল,
‘বাদ দে তো ওর কথা। দ্রুত হাঁট। তোর প্রিপারেশন কেমন রে?’
‘যা-তা অবস্থা। কিচ্ছু পারি না।’
‘আমারও একই অবস্থা। আর এ কয়দিন তো পড়ায় মনই দিতে পারিনি। পড়তে বসলেই খালি অন্য চিন্তা মাথায় আসে।’
তিনতলায় এসে ৩০৫ নম্বর কেবিন খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না ওদের। অস্বস্তি নিয়েই টোকা দিল দরজায়। ভেতরে কথা বলছেন একাধিক মানুষ, শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকেই। আলতো করে দরজা খুললেন একজন।
‘একদম দোস্ত। পুরা সেইম। আচ্ছা, আমরা কি কিছু নিয়ে যাব জিকোর জন্য?’
‘কী নেব? একটা ফুটবল নিয়ে যাই। মজা হবে।’
‘ভালো মানুষ হওয়ার উপায় টাইপ বইও দিতে পারি। যদি কাজ হয়।’
‘ও পড়বে বই…হেহেহে। তোর যা কথা!’
হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা। দুজনের কেউই এ ধরনের হাসপাতালে আগে আসেনি। দুষ্টুমি অনেক করেছে ওরা, কিন্তু হাত-পা ভাঙেনি ওদের। শহরের এত মানুষ যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, এখানে না এলে ধারণা করতে পারত না ওরা। ইমার্জেন্সি রুমের পাশে এসে দাঁড়াল ইভান আর রাহাত। অ্যাম্বুলেন্স থেকে স্ট্রেচারে করে নামানো হচ্ছে এক রোগীকে। ৩০-৩৫ বছর বয়স হবে। শরীরের নিচের অংশটা থেঁতলে গেছে। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ফাইল দিয়ে তাকে বাতাস করছে একটা মেয়ে। ভর্তির জন্য এদিক–সেদিক ছোটাছুটি করছেন তাঁর স্ত্রী। পুরো পরিবেশটাই কেমন মন খারাপ করা। ইভান আর স্ট্রেচারের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওরা আসতেই একজন মাঝবয়সী লোক পান চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘দেয়াল ভাইঙ্গা পড়সে শইলের উপরে।’
শিউরে উঠল ইভানরা। থু করে পানের পিক ফেলে লোকটা বললেন, ‘সিমেন্টের কাম করে। দেয়ালে ইট বসাইয়া সিমেন্ট করতাসিল, আঁতকা দেয়ালটা ভাইঙ্গা পড়ল হের উপরে। দুইটা ঠ্যাংই মনে হয় ভাঙছে।’
‘ভাই, আমারে একটু পানি দেন ভাই।’ স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা লোকটা বললেন দুর্বল কণ্ঠে।
‘এই, এরে কেউ পানি দেন তো।’ পান খাওয়া লোকটা বললেন চিৎকার করে। তারপর আবার পানের পিক ফেললেন। স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা লোকটার মাথায় বাতাস করা মেয়েটা অসহায়ের মতো এদিক–ওদিক তাকাচ্ছে।
‘আচ্ছা, আমরা পানি নিয়ে আসছি।’ বলল ইভান। ‘রাহাত, তুই থাক এখানে।’ বলেই ছুটল ও। হাসপাতালের বাইরেই পানির দোকান আছে। দুই লিটারের একটা বোতল নিয়ে কিনে নিয়ে এল ইভান। রাহাত আর ওই মেয়েটার সঙ্গে মিলে ধরাধরি করে পানি খাওয়ানো হলো লোকটাকে। একটু পর ছুটে এলেন তাঁর স্ত্রী। সঙ্গে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। স্ট্রেচার ঠেলে লোকটাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলেন তাঁরা। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল ইভান আর রাহাত।
‘কী ভয়াবহ অবস্থা, দেখেছিস?’
‘হ্যাঁ। চিন্তা কর, এ রকম গুরুতর রোগী, অথচ ট্রিটমেন্ট শুরু করতে কত সময় চলে গেল। আর এই সব কনস্ট্রাকশনের কাজ যারা করে, তাদের সেফটির কথা কেউ ভাবেই না। কী আশ্চর্য!’
‘হ্যাঁ, সাথের লোকজনগুলাও কেমন দায়সারা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পান খাচ্ছে। ধরে ঘাড়ানো দরকার এ রকম লোকজনকে।’
‘চল আমরা এগোই। কয় তালায় আছে জিকো?’
‘লিফটের তিন।’
‘চল।’
তিনতলায় এসে ৩০৫ নম্বর কেবিন খুঁজে বের করতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না ওদের। অস্বস্তি নিয়েই টোকা দিল দরজায়। ভেতরে কথা বলছেন একাধিক মানুষ, শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকেই। আলতো করে দরজা খুললেন একজন।
‘তোমরা?’
‘জিকোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ বলল ইভান।
‘ও আচ্ছা, এসো।’ পুরো দরজা খুলে দিলেন লোকটা। ‘জিকো, দেখো কারা এসেছে…’
‘চলে যেতে বলো ওদের।’ বিছানা থেকে মাথা উঠিয়ে চেঁচিয়ে বলল জিকো।
‘আরে, ছি…’
‘আচ্ছা…আমরা চলে যাচ্ছি।’ তাড়াতাড়ি বলল ইভান। বেরিয়ে এল বাইরে। ভদ্রলোকও বেরিয়ে এলেন ওদের সঙ্গে। ইভানের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘খুব রেগে আছে। সবার সঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তোমরা কিছু মনে কোরো না।’
‘আপনি…?’
‘আমি ওর মামা। তোমরা একটু দাঁড়াও। ভেতরে ওয়ার্ডবয় ড্রেসিং করছে তো, ওদের কাজ শেষ হলেই আমি ডাকব তোমাদের।’
‘জি।’
দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেলেন জিকোর মামা। রাহাত বিরক্ত হয়ে বলল,
‘চল, আমরা চলে যাই।’
‘দেখা করে যাই একটু।’
‘কী রকম ব্যবহার করল দেখেছিস?’
‘হু।’
তখনই আবার খুলে গেল দরজা। ড্রেসিংয়ের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ওয়ার্ডবয়। জিকোর মামার ইশারায় ভেতরে ঢুকল রাহাত আর ইভান। মামা বললেন, ‘তোমরা কথা বলো, আমি একটু আসছি।’
দরজা ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই অস্বস্তিকর একটা নীরবতা নেমে এল কেবিনে। বেডের পাশের টেবিলে ফল, বিস্কুট, জুস। সেদিকে তাকিয়ে রইল রাহাত। কথা শুরু করল ইভানই।
‘কী অবস্থা এখন?’
‘এই আরকি। আছি।’ অন্যদিকে তাকিয়ে বলল জিকো। ব্যান্ডেজ করা পা–টা বালিশ দিয়ে উঁচু করে রাখা। আবার অস্বস্তিকর নীরবতা। কিছুক্ষণ পর জিকো বলল,
‘তোরা হঠাৎ কী মনে করে?’
‘মনে হলো যাওয়া দরকার। তাই…’
‘মজা দেখতে এসেছিস, তাই না?’
‘আরে না।’
‘বস। রাহাত, তুই আঙুরের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? খাবি? খাইলে খা। প্যারা নাই।’
‘খাই, তাহলে। ইভান, তুই খাবি?’ টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল রাহাত।
‘না।’
উত্তর দিল না ইভান। হাসপাতাল থেকে ওরা চলে এসেছে রাহাতদের বাসার ছাদে। বসেছে পানির ট্যাংকের ওপর। বিকেলে না খেললে অনেক সময় এখানে সময় কাটায় ওরা। ওপর থেকে দারুণ লাগে শহরটা।
‘সময়ই কাটে না, বুঝলি?’ বলল জিকো। এত ভদ্রভাবে জিকোকে কখনো কথা বলতে শোনেনি ওরা। ‘আসলে, এভাবে সারা দিন শুয়ে থাকিনি কখনো।’
‘তোর বন্ধুরা আসে না?’
‘এসেছিল। আমিই আসতে মানা করেছি। ওদের দেখলে আরও খারাপ লাগলে। মনে হয়, আমি একটা #!@******।’ গালি দিয়ে ফেলল সে । অন্য সময় হলে বিরক্ত হতো ইভান। এই পরিস্থিতিতে হেসে ফেলল।
‘হঠাৎ খেয়াল করলাম, তোরা আমাকে তুই করে বলছিস।’ জিকোর কথায় চমকে উঠল ইভান। আসলেই তো। ঝগড়ার সময় ‘তুই’ বলেছিল। সেটাই মাথায় ঢুকে গেছে।
‘সরি।’
‘আরে প্যারা নাই, প্যারা নাই। বল।’ মুখে কয়েকটা আঙুর পুরে অবাক হয়ে তাকাল রাহাত। এদিক–ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ উঠে বসার চেষ্টা করল জিকো।
‘কিছু লাগবে?’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘রাহাত, দেখ তো, মামা কোথায়! ডেকে নিয়ে আয়।’
‘আচ্ছা, দেখছি।’ আঙুর খেতে খেতেই বেরিয়ে গেল রাহাত। আবারও নীরব হয়ে গেল কেবিনটা।
‘যা ঘটেছে, তার জন্য আমি সরি।’ মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল ইভান। ‘নিজের নিরাপত্তার জন্যই আমি ডগেশকে ডেকেছিলাম। শুধু ভয় দেখাতে।’
‘ভাই রে ভাই! তোর ওইটা কুত্তা না চিতাবাঘ ভাই! আমার তো ভয়ে কলিজা–কিডনি নড়ে গিয়েছিল। আমিও তোদের সঙ্গে যা যা করেছি, তার জন্য সরি রে। আমার মাথা থাকে গরম। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। আমারও একটা শিক্ষা পাওয়া দরকার ছিল। তবে ঠ্যাং ভাঙাটা বেশি হয়ে গেল।’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা শোন, আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে।’
‘আমি!’
‘হ্যাঁ। আমার বন্ধু–বান্ধব, ভাই–ব্রাদার আছে। কিন্তু এই কাজটা তোকেই দিতে চাই। আমি জানি, তুই ঝামেলা করবি না।’
‘কী কাজ?’
চাদরের নিচ থেকে একটা ফোন বের করল জিকো। ইভানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা আমার ফোন। এটা তোর কাছে রাখবি। আমি বললে আবার নিয়ে আসবি।’
‘তোর ফোন আমি কেন রাখব? অসম্ভব।’
‘পকেটে ঢোকা আগে। আমি বলছি। মামা দেখে ফেললে ঝামেলা হবে।’ ফোনটা পকেটে ঢোকাল ইভান। জিকো বলল,
‘এটা আমার এক্সট৶া ফোন। বাসায় জানে না। পা ভাঙার পর আমাকে খুব চাপে রেখেছে। আমার দুইটা ফোনই নিয়ে গেছে। এই একটা কোনোমতে লুকিয়ে রেখেছি। এটা তোর কাছে রাখবি।’
‘আমার কাছে কেন?’
‘আমার বন্ধুর কাছে রাখতে পারতাম। কিন্তু ওরা এটা নাড়াচাড়া করবে। ওদের আমি চিনি। তুই আমার শত্রু। কিন্তু আমি জানি, তুই মানুষটা সৎ। অন্যের ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করবি না। এইটাই, আর কিছু না।’
‘ওকে। সমস্যা নাই।’
‘একটা আছে।’
‘কী?’
‘বিষয়টা গোপন রাখতে হবে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু…’
ঠিক তখনই কেবিনে ঢুকল রাহাত। সঙ্গে মামা। দ্রুত সরে আগের জায়গায় চলে এল ইভান। রাহাত খেয়াল করল ব্যাপারটা। কিন্তু কিছু বলল না।
‘আজকের মতো যাই আমরা।’ উঠে দাঁড়াল ইভান।
‘সেকি, বসো আরও কিছুক্ষণ।’ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন মামা।
‘না না, ওরা যাক। আমার একটু টয়লেটে যেতে হবে।’ দ্রুত ওদের তাড়াতে চাইল জিকো।
‘আচ্ছা, আবার এসো।’
মামা আর জিকোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল ওরা।
*
‘গাধা নাকি তুই?’ বিরক্ত হয়ে বলল রাহাত।
উত্তর দিল না ইভান। হাসপাতাল থেকে ওরা চলে এসেছে রাহাতদের বাসার ছাদে। বসেছে পানির ট্যাংকের ওপর। বিকেলে না খেললে অনেক সময় এখানে সময় কাটায় ওরা। ওপর থেকে দারুণ লাগে শহরটা। অফিস থেকে ফেরা মানুষে ভর্তি মেট্রো একটু পরপর শাঁই করে চলে যাচ্ছে। একটু পরই অন্ধকার হয়ে যাবে। বাসায় চলে যেতে হবে ওদের। নাশতা খেয়েই পড়তে বসতে হবে।
‘কেন তুই ওর ফোনটা নিলি?’
‘আরে ও এত করে বলল, না করতে পারলাম না।’
‘ওই ব্যাটাকে একদম বিশ্বাস করি না আমি।’
‘আজ তো ভালোই ব্যবহার করল। সরি বলল।’
‘নিশ্চয়ই কোনো শয়তানি বুদ্ধি আছে ওর।’
‘সব সময় সন্দেহ করিস কেন? পা ভেঙে শিক্ষা হয়ে গেছে ওর। মানুষের পরিবর্তন হয় না?’
‘হয়। তবে শয়তানের পরিবর্তন হয় না। ও একটা বদমাইশ।’
‘আচ্ছা, বাদ দে। ভুল একটা করে ফেলেছি, এখন তো আর কিছু করার নেই। পরে গিয়ে দিয়ে এলেই হবে।’
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাহাতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে এগোল ইভান। যাওয়ার পথে দেখে গেল রকিকে। ক্ষত অনেকটাই শুকিয়ে এসেছে কুকুরটার। গলার কাছে আদর করে ওকে রুটি খেতে দিল ইভান। লেজ নাড়তে নাড়তে রুটি চিবাতে লাগল রকি। বাসায় ফিরেই ইভান নিজের ড্রয়ারে রেখে দিল জিকোর ফোনটা। তারপর হাতমুখ ধুতে গেল বাথরুমে। হাতি খেয়ে ফেলার মতো খিদে পেয়েছে ওর। হাতমুখ ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলো বাথরুম থেকে। দেখল, ধোঁয়া উঠছে পড়ার টেবিলের ওপর রাখা নুডলসের বাটি থেকে। ‘থ্যাংক ইউ ফুফু!’ চিৎকার করে বলল ইভান। ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে পড়তে বস,’ ও ঘর থেকে চেঁচিয়ে জবাব দিলেন ফুফু। হেসে ফেলল ইভান। সব কথার একই জবাব—পড়তে বস।
পড়ায় অবশ্য খুব একটা মন বসল না ওর। ইদানীং এই অমনোযোগ বেশ ভোগাচ্ছে ওকে। ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করার কথা ভাবল ইভান। তবে জিকোর সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো হয়ে যাওয়ায় স্বস্তিও লাগছে কিছুটা। ‘আশা করি এরপর আর ওর সঙ্গে ঝামেলা হবে না,’ ভাবল ইভান। পড়া না পড়ার মধ্যেই খাবারের ডাক দিলেন ফুফু। রাতের খাবার শেষ করেই বিছানায় উঠে বসল ইভান। বালিশে কাত হয়ে শুয়ে নিজের ফোন বের করল। ইনবক্সে পাঠানো বন্ধুদের ভিডিওগুলো দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। হঠাৎ কলবেলের শব্দে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকাল ইভান। ১১টা ৩৭। এত রাতে কে এল? প্যাচপ্যাচ শব্দ শুনেই ও বুঝল, স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে দরজা খুলতে যাচ্ছেন ফুফা। আবার ফোনে মন দিল ইভান।
‘কে?’ এ পাশ থেকে বললেন ফুফা।
‘একটু খোলেন। কথা বলব।’ উত্তর এল ওপাশ থেকে। পেট চুলকে হাই তুলে দরজা খুলেই চমকে গেলেন ফুফা। দরজার ওপাশে দুজন পুলিশ সদস্য। সঙ্গে এক ভদ্রলোক। ভয় পেয়ে গেলেন ফুফা। আমতা আমতা করে বললেন,
‘কী ব্যাপার?’
‘ইভান আপনার ছেলে?’
‘ইয়ে…হ্যাঁ, কেন? কী হয়েছে?’
‘ও কোথায়?’
‘ঘরেই আছে।’
‘ডাকেন ওকে। অভিযোগ আছে, ও একটা ফোন চুরি করেছে।’
‘কী বলছেন! ও এ রকম ছেলেই নয়।’
‘আরে ডাকেন ওকে!’ কড়া ধমক খেলেন ফুফা। মাথায় কাপড় দিয়ে ‘কী হয়েছে? পুলিশ কেন?’ বলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ফুফু। ততক্ষণে ডাইনিং রুমে ছুটে এসেছে ইভান। ওকে দেখেই ফুফা বললেন,
‘ইভান…ওরা কী বলছে? তুই নাকি ফোন নিয়েছিস?’
ইভান তাকিয়ে দেখল, পুলিশের দুই সদস্যর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন জিকোর মামা। যা বোঝার, বুঝে ফেলল সঙ্গে সঙ্গেই। আবার ফাঁসানো হয়েছে ওকে।
চলবে…
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619