‘জিকোকে আমি পেটাব।’ হেডফোনের তার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবল ইভান। বিছানায় শুয়ে আছে সে। হেডফোন চেপে রাখা দুই কানে গানের ঝড়, মাথায় চিন্তার। গানের কথাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে চিন্তার ধাক্কায়। ‘হাসপাতালে গিয়ে পেটালে কেমন হয়? মারলে তো নিশ্চয়ই আবার হাত–পা ভাঙবে। সে ক্ষেত্রে আর হাসপাতালে নেওয়ার ঝামেলা নেই। মেরে শুধু নার্সকে বলব, সিস্টার একটু দেখবেন। হাতটা মনে হয় ভেঙে গেছে। ও, ভুলেই গিয়েছি, কপালেও বোধ হয় কয়েকটা সেলাই লাগতে পারে…আমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়ে আরামে বদমায়েশি করে বেড়াবে, এটা হতে পারে না। অবশ্যই ওকে পেটাব আমি।’
বাঁদিকে কিছুটা কাত হলো ইভান। হেডফোন কানে থাকলে কাত হয়ে শুতে পারে না ও, চাপ লাগে কানে। হুট করেই এসি ডিসির ‘হাইওয়ে টু হেল’ গানটার কথা মনে পড়ল কেন যেন! গানটা ছেড়েই ফোনের অঅওয়াজ বাড়িয়ে দিল ইভান। গিটারের রিফটা শুনেই শরীর কেঁপে উঠল ওর। ‘কী তুখোর রিফ!’ ভাবল ও। ‘প্রতিশোধ ব্যাপারটা মনে হয় ভালো নয়। প্যাপিলন উপন্যাস পড়ে চিন্তাভাবনাই বদলে গিয়েছিল। প্রতিশোধ, শাস্তি এগুলো কি আসলে সমাধান? নাকি নতুন সমস্যার সৃষ্টি? প্রতিশোধ নিতে গিয়েই তো এত কিছু হলো। আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে জিকো কত ঘটনা ঘটাল। এখন আমি আবার সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছি। এই চক্র শেষ হবে কীভাবে, কে জানে। আবার ওকে একেবারে ছেড়েও তো দেওয়া যায় না। মানে, একটা ছেলে দিনের পর দিন অন্যায় করে যাবে, ক্ষমতা দেখিয়ে যাবে, তার কোনো বিচার হবে না? এটা কেমন কথা? নাহ, পেটানো ছাড়া এর কোনো সমাধান নেই। কঠিন পিটানি তো খায়নি কোনো দিন। না খাওয়া পর্যন্ত সোজা হবে না জিকো।’
দিনের বেলায়ও বেশ মশার উৎপাত ঘরে। একেকটার কী বিশাল সাইজ। একটু মনোযোগ দিয়ে হাত দিয়েই ধরে ফেলা যাবে। কয়েকটা মশা ধরে ফেলার চেষ্টা করল ইভান। ‘গেম বানাতে পারলে ভালো হতো,’ ভাবল ও। ‘একটা গেম বানাতাম, যেখানে ব্যাট দিয়ে খালি মশা মারতে হবে। যত মশা মারব, তত বেশি পয়েন্ট। পর্যায়ক্রমে মশা আসবে তুলনামূলক বেশি গতিতে, তাদের শক্তিও বাড়বে, একটা–দুইটা বাড়িতে মরবে না ধরনের। ব্যাটের শক্তিও বাড়বে পর্যায়ক্রমে। পয়েন্ট বেড়ে গেলে ব্যাটের বদলে নেওয়া যাবে শক্তিশালী ফগার মেশিন। মাঝেমধ্যেই ফগার মেশিন দিয়ে অজ্ঞান করে মশা মারার মতো বোনাস টাইম আসবে। আবার কিছু মশা থাকবে এডিসের মতো, একবার কামড়ালেই গেম ওভার। গেমটা খেলা যাবে দুইটা মেয়র হয়ে। একটা উত্তরের মেয়র, একটা দক্ষিণের। যেকোনো একটা নিয়েই খেলা যাবে এই গেম।’ নিজের কল্পনায় নিজেই হাসল ইভান।
‘হাইওয়ে টু হেল’ শেষে কখন যে অপরিচিত একটা গান বেজে উঠেছে, খেয়ালই করেনি ইভান। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, গানটার নাম ‘ওয়াক দ্য আর্থ’। ব্যান্ডের নাম ইউরোপ! ‘এ আবার কেমন নাম? কোনদেশি ব্যান্ড এটা?’ ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে অবাক হলো ইভান। ‘১৯৭৯ সালের ব্যান্ড, এখনো অ্যাক্টিভ! সেই তো!’ সুইডিশ একটা ব্যান্ড আবিষ্কার করতে পেরে বেশ ভালো লাগল ওর। শুনে ফেলল ওদের সবচেয়ে বিখ্যাত গান ‘ফাইনাল কাউন্টডাউন’। দারুণ লাগল গানটা। ‘আগের দিনের গানগুলো কি বেশি ভালো হতো?’ ভাবল ইভান। নতুন শিল্পী বা ব্যান্ড খুঁজে পেলে ওটার পেছনে অনেক সময় দেয় ও। কোথাকার শিল্পী, কী কী গান আছে, ব্যান্ডের দর্শন কী, কোন ধরনের মিউজিক করে—এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতে সময় চলে যায় ওর। আজও সে রকমই হলো। সোজা হয়ে শোয়ামাত্র ইভানের চোখ পড়ল দেয়ালের ঘড়ির দিকে। ‘স্কুল ছুটি হয়ে গেছে এতক্ষণে।’ লম্বা একটা শ্বাস ফেলল ও। ক্লাস ফাইভে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ইভান। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন—কতশত স্মৃতি! মা–বাবার হাত ধরে স্কুলের ফটক দিয়ে ঢুকেছিল ইভান। পোকেমনের ছবি আঁকা একটা ব্যাগ ছিল ওর কাঁধে। নতুন স্কুলের ড্রেসটা বেশ ঢিলাই হয়েছিল ওর আগে। প্যান্টটা একটু পরপর নেমে যাচ্ছিল কোমড় থেকে। দুহাত দিয়ে বারবার টেনে প্যান্ট ওঠাচ্ছিল ইভান। পেছনে তাকিয়ে দেখছিল, ওড়নায় মুখ ঢেকে হাসি আটকে রেখেছে মা। বাবা হাসি আটকানোর চেষ্টাই করেনি। বাবার দরাজ হাসি থেকে বাঁচতে দৌড়ে স্কুলের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল ইভান। অথচ এবার স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার সময় পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখেনি ও। মা তো পৃথিবীতেই নেই, বাবাও ওর কাছ থেকে অনেক দূরে। সামনে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন ফুফা। স্কুলের ভবনটাই শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে, যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়।
এই স্কুল থেকে বিদায়টা এভাবে হবে, কখনো ভাবেনি ইভান। এসএসসির ব্যাচ ওরা, টেস্ট পরীক্ষার পর প্রতিবার ঢাকার বাইরে পিকনিকে যায় এসএসসির ব্যাচ। নানা রকম পরিকল্পনা থাকে সেই পিকনিক নিয়ে। ইভানদেরও অনেক পরিকল্পনা ছিল। কদিন আগেও পিকনিকে কোন ব্যান্ড আনা যায়, এ নিয়ে আলোচনা চলেছে কয়েক দফা। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আয়োজনের দায়িত্ব যে ওর ওপর এসে পড়বে, স্পষ্টই বুঝতে পারছিল ইভান। মোটামুটি একটা খসড়াও সাজিয়ে ফেলেছিল মনে মনে। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সে এখন পিকনিকের বাইরে।
গান বন্ধ করে হেডফোন খুলে রাখল ইভান। মনকে শান্ত করতে পারছে না কিছুতেই। মেসেঞ্জার খুলে দেখল আবার। ক্লাসের অনেকেই মেসেজ দিয়েছে। সবারই একই ধরনের মেসেজ, ‘দোস্ত, এটা কী হলো? মেনে নিতে পারছি না।’
‘মেনে নিতে না পারলে নিস না।’ উত্তর লিখতে শুরু করল ইভান। ‘কী করেছিস তোরা? স্যারকে গিয়ে বলেছিস যে এটা সাজানো ঘটনা? প্রতিবাদ করেছিস একবারও?’ কয়েক সেকেন্ড লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকল ও। তারপর ব্যাকস্পেস চেপে মুছে ফেলল পুরোটা। আবার লিখল, ‘ব্যাপার না।’ সঙ্গে একটা হাসির ইমোজি।
ইভানের ধারণা, এখন আর মন খারাপ করে কোনো লাভ নেই। যা হবার হয়ে গেছে। আবার কানে হেডফোন গুঁজে দিল ও।
গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, টের পায়নি ইভান। ঘুম ভাঙল ফুফুর ডাকে।
‘ইভান, ওঠ। তোর এক ফ্রেন্ড এসেছে।’
‘আমার ফ্রেন্ড!’ চোখ কচলে উঠে বলল ইভান। ‘ভেতরে আসতে বলতা।’
‘বলেছিলাম, ও বলল আসবে না।’
দ্রুত উঠে গিয়ে ভেড়ানো দরজা টেনে খুলল ইভান। বিস্মিত হলো সে। রুশা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে।
‘আরে তুমি!’
‘আজ রবিবার নাটকের ওই মিমটা দেখেছ—চলে এলাম?’
‘দেখেছি।’
‘সে রকমই…চলে এলাম।’ হাসল রুশা।
‘কী ব্যাপার? বাসা চিনলা কীভাবে?’
‘তোমার বাসা চেনা কোনো ব্যাপারই না। এলাকার কুকুর-বিড়ালকে জিজ্ঞেস করলেই তো ওরা বলে দিতে পারে। পারে না?’
‘ও, তুমি তো আবার বিড়ালের ভাষা বোঝো। আসো, ভেতরে এসে বসো।’
‘বসব না আজকে। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। নিচে নামবা?’
‘নামা যায়। দাঁড়াও, বলে আসি ফুফুকে।’
ওকে আবার ঘরে ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন ফুফু। তাঁর শরীর ভালো না। মেয়েটা আবার কোনো বিচার নিয়ে এসেছে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ইভানকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে ইভান? মেয়েটা কে?’
‘ওর নাম রুশা। আমাদের ক্লাসের।’
‘বাসায় হঠাৎ…কোনো ঝামেলা করিস নাই তো আবার?’
‘আরে না। আমার বাসায় যে বিড়ালটা এনেছিলাম, ওটা এখন ওর কাছে। বিড়াল পোষার অভ্যাস নাই ওর। এ জন্যই হয়তো কথা বলতে এসেছে।’
ঠিক আশ্বস্ত হতে পারলেন না ফুফু। ‘তুই কি এখন আবার বাইরে যাচ্ছিস নাকি?’ ‘এই একটু যাচ্ছি’ বলে ভেতরে গিয়ে চোখে–মুখে পানি দিল ইভান। ঘুম ঘুম ভাবটা দূর করা দরকার। দ্রুত মাথার এলোমেলো চুল ঠিকঠাক করে নিল যতটা সম্ভব। তারপর ফুফুকে বলে বেরিয়ে পড়ল রুশার সঙ্গে।
বাসার সামনের গলি ধরে হাঁটা শুরু করল ওরা। রুশা বলল, ‘কী হয়েছিল বলো তো। স্কুলে নানা রকম কথা শুনলাম।’
প্রসঙ্গটার জন্য মানসিকভাবে তৈরিই ছিল ইভান। উত্তরটা আরও অনেকবার দিতে হবে, জানে ও। অস্বস্তি কাটিয়ে যা ঘটেছে বলতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতেই মন দিয়ে পুরো ঘটনা শুনল রুশা। চিন্তিত মনে হলো ওকে।
‘এখন তাহলে কী করবে? টেস্ট দেবে কীভাবে?’ জানতে চাইল রুশা।
‘অন্য স্কুলে ভর্তি হতে হবে। টিসি খাওয়া ছাত্রকে তো আর ভালো স্কুল নেবে না। যেসব স্কুল এ রকম ছাত্র ভর্তি নেয়, সেখানে যেতে হবে। ফুফা দেখছেন ব্যাপারটা।’
‘স্কুল কোনো ব্যাপার না। এই স্কুলের পড়াশোনাও তো এমন আহামরি কিছু না। দু-তিনজন ছাড়া অধিকাংশ টিচারই তো ক্লাসে এসে ঘুমায়।’
‘এই স্কুলে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে। কত মেমোরি। কত বন্ধু।’
‘এগুলো প্রথম প্রথম কষ্ট লাগে। আমাকেও অনেকবার স্কুল বদলাতে হয়েছে। প্রথম প্রথম মনে হতো ফ্রেন্ডদের ছাড়া কীভাবে থাকব, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। ফ্রেন্ডরাও বিজি, যোগাযোগই হয় না সেভাবে। সামনাসামনি দেখা না হলে কেউ মনে রাখে না বোধ হয়।’
‘হতে পারে।’
‘এগুলো নিয়ে যত কম চিন্তা করবা, তত দ্রুত ভুলে যেতে পারবা।’
‘সেটা জানি। কিন্তু একটু পরপরই মনে পড়ে।’
‘স্বাভাবিক। আচ্ছা শোনো, আমি তোমার কাছ থেকে বিষয়টা জানতে এসেছি, এটা ঠিক। কিন্তু আরও একটা উদ্দেশ্য আছে।’
‘কী উদ্দেশ্য?’
‘একটা সিক্রেট।’
‘তোমার দেখি সবই সিক্রেট।’
‘হ্যাঁ, কোনো সমস্যা? মিশবা না আমার সাথে?’
‘আরে না। সেটা বলি নাই। আচ্ছা, বলো তুমি।’
‘তোমার ব্যাগে যে ছুরিটা পাওয়া গিয়েছিল, সেটার ব্যাপারে জানো তুমি?’
‘ও মা, আমার ব্যাগে পাওয়া গেছে আর আমি জানব না? এত এত ঝামেলার শুরু তো ওই ছুরি দিয়েই।’
‘হ্যাঁ। ওই ছুরি দিয়ে একজনকে খুন করা হয়েছিল। তোমার ব্যাগে যেদিন পাওয়া গেছে, তার আগের রাতে।’
‘আমি জানি সেটা।’
‘লোকটা কে, কী করে তা নিয়ে কি ঘাঁটাঘাঁটিও করেছিলে তুমি?’
‘করেছিলাম, অনলাইনে যতটুকু পারি। কেন?’
‘আমার মনে হয় খুনটা কারা করেছে, সেটা আমি বের করতে পারব।’
‘অ্যাঁ? মাথা ঠিক আছে তোমার?’
‘এই শোনো, কথায় কথায় মাথা ঠিক আছে—এ রকম বলবা না। মুরব্বি নাকি তুমি? মুরব্বিরা এ রকম জাজ করে না বুঝে, না জেনে।’
‘এটা অবশ্য ঠিকই বলেছ।’
‘তুমি হেল্প করবে আমাকে?’
‘আবার হেল্প! তোমাকে হেল্প করতে গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ব, বুঝতে পারছি না।’
‘তোমার যে অবস্থা, তুমি এমনিতেও কোনো না কোনো বিপদে পড়বেই। বিপদ নিয়ে চিন্তা করে লাভ আছে?’
‘এটাও ঠিক। তুমি তো আজকে বেশ লজিকাল কথা বলছ। ব্যাপারটা কী?’
‘কোনো দিন আমি ইলজিক্যাল কথা বললাম?’
‘এই তো কদিন আগে বললা, তোমার বিড়াল কথা বলে।’
‘তো?’
‘ওই আরকি, লজিক ব্যাপারটা তোমার সঙ্গে যায় না।’
শুনে থমকে গেল রুশা। হাঁটা থামাল ইভানও। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল রুশা। বলল, ‘টাইম আসুক, তুমিও বুঝবে কোনটা লজিক্যাল, কোনটা ইলজিক্যাল। এখন যাই আমি। তোমাকে জানাব কখন কী করতে হবে।’
ইভানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পা চালাল রুশা। একটু এগিয়েই রিকশা নিয়ে নিল মেয়েটা। কী করবে, তা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল ইভান। বন্ধুরা কোচিংয়ে। এই সময়টা ডগেশের সঙ্গে কাটালেই মনটা ভালো হবে, ভাবল ও। ইভান এগোল তিন রাস্তার মোড়ের দিকে।
*
নাশপাতিতে একটা কামড় দিয়েই বিরক্তিতে চোখ–মুখ কুঁচকে গেল জিকোর। ‘এই ফালতু জিনিস মানুষ কেমনে খায়? ধুর।’ থু করে ফেলে দিল মুখ থেকে। হাত বাড়িয়ে জুসের বোতলটা নিল টেবিল থেকে। কয়েক ঢোক জুস খেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল জিকো। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে এ রকম ‘আজেবাজে’ নানা কিছু খেতে হচ্ছে ওকে। শুয়ে থাকতে থাকতে এমনিতেই বিরক্ত সে, তার ওপর আরেক অত্যাচার এসব খাবার। বিশেষ করে এই হাসপাতালের স্যুপটা। জিকো ঠিক করেছে, সে যাদের অপছন্দ করে, তাদের সবাইকে একবাটি করে স্যুপটা খাওয়াবে। ‘ইভানকেও একদিন খাওয়ানো দরকার স্যুপটা।’ ভেবে আপনমনে হেসে ফেলল জিকো। ‘ব্যাটা, ফার্মের মুরগি হয়ে আমার সঙ্গে লাগতে আসিস! একদম টিসি। হে হে!’ পাশ থেকে রিমোট নিয়ে টিভি অন করল জিকো। চ্যানেল বদলাতে থাকল একের পর এক। দেখার কিছু পেল না টিভিতে। বিরক্ত লাগছে জিকোর। বারেকের চায়ের দোকানে কত দিন বসা হয় না। দিনে তিন–চারবার ওই দোকানের বেঞ্চে না বসলে ভালো লাগে না জিকোর। এভাবে শুয়ে থাকা যায়? হাসপাতালে থাকায় অনেক কাজ করতে পারছে না জিকো। তার ওপর সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে মামা। নির্ভার হয়ে কথাও বলা যাচ্ছে না। নইলে ফোনেই কিছু নির্দেশনা দেওয়া যেতে। এই সুযোগে অন্যরা ওর জায়গাটা নিয়ে নেবে কি না, কে জানে। জুনিয়রদের ওপর বিশ্বাস নেই জিকোর। এলাকার মাঠে কিসের যেন মেলা হচ্ছে। ব্যাপারটা জিকোকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। মামা না বললে তো জানতেই পারত না জিকো। এসব ছোটখাটো ব্যাপার, কিন্তু অবহেলা করার উপায় নেই। এলাকার নেতৃত্বে আসতে চাইছে সে, যেকোনো ঘটনা তাকে জানানো জুনিয়রদের দায়িত্ব। কেবিনে সারাক্ষণ মামা থাকায় ওরা হয়তো আসতে অস্বস্তি বোধ করছে। প্রথম প্রথম হাসপাতালে এসে কিংবা ফোনে খোঁজখবর নিয়েছে ওর বন্ধুবান্ধবরা। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই কমছে তাদের ফোনের সংখ্যা। বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিল জিকো। ‘কিছু একটা দেখা দরকার ইউটিউবে।’ ভাবল ও। ডিসপ্লের আলো জ্বলতেই বিরক্ত হলো আবার। ‘ধুর, চার্জ দেওয়া হয়নি।’ বিরক্ত হয়ে ফোনটা একপাশে ছুড়ে ফেলল জিকো। অস্থির লাগছে ওর। পাশ থেকে টেনে মামার ফোনটা নিল। ‘মামা, তোমার ফোনটা নিলাম একটু।’ চেঁচিয়ে বলল জিকো।
‘নে।’ বাথরুমে গোসল করতে করতে বললেন মামা।
‘পাসওয়ার্ড যেন কত?’
‘কী?’ ভালোভাবে শোনার জন্য শাওয়ার বন্ধ করলেন জিকোর মামা।
‘আরে পাসওয়ার্ড, পাসওয়ার্ড।’
‘ওয়ান টু থ্রি ফোর।’
ফোনটা খুলেই বিরক্তি বেড়ে গেল জিকোর। এত অগোছালো ফোন হয় কারও? কোথায় কোন অ্যাপ, কোনো কিছুর ঠিক নেই। ওয়ালপেপারটাও বাজে। অ্যাপগুলো ড্র্যাগ করে একটু গোছানোর চেষ্টা করল জিকো। হঠাৎ চাপ পড়ে খুলে গেল ফোনের গ্যালারি। গ্যালারিতেও পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছে মামা। ‘হেভি লোক তো মামা!’ অবাক হলো জিকো। কৌতূহলও হলো ওর। ‘কী হতে পারে পাসওয়ার্ড?’ চিন্তা করল কয়েক সেকেন্ড। তারপর লিখল ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর’। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল গ্যালারি। গ্যালারির ছবিগুলো দেখার ইচ্ছা হলো ওর। কয়েটা ছবি স্লাইড করে দেখে ফেলল একের পর এক। হঠাৎ একটা ছবি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। দ্রুত স্লাইড করে আরও কয়েকটা ছবি দেখে ফেলল। ছবিগুলো দেখে হাত কাঁপতে শুরু করল জিকোর। ‘মামার ফোনে লাশের ছবি কেন? কার লাশ এটা? ’ হাতড়ে খুঁজল নিজের ফোন। পরক্ষণেই মনে পড়ল, ফোনটা একটু আগেই দূরে ছুড়ে ফেলেছিল নিজেই। হাতে ভর দিয়ে বহুকষ্টে ডানপাশে সরল ও। আর একটু এগোলেই হাত বাড়িয়ে নিতে পারবে ফোনটা। ঠিক তখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন মামা। জিকোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, কী দেখছিস তুই?’
কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা খুঁজে পেল না জিকো। দ্রুত একটা কিছু সাজিয়ে বলতে হবে ওকে। কারণ, মামা এগিয়ে আসছেন ওর দিকেই।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619