‘ইভান, অ্যাই ইভান! ওঠ!’ ঘুমন্ত ইভানের গায়ে ধাক্কা দিলেন ফুফু। ধড়মড় করে উঠে বসে চোখ কচলাল ইভান। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না ও। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল,
‘কী হয়েছে ফুফু?’
‘সন্ধ্যাবেলা ঘুমাচ্ছিস কেন? ওঠ।’
‘উঠছি। কিছু বলবে?’
‘হ্যাঁ। আম খাবি? কাটব?’
বড় করে শ্বাস ফেলে আবারও চোখ কচলাল ইভান। ঘুম থেকে ডেকে তুলে কেউ ‘আম খাবি?’ জিজ্ঞেস করলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত, মাথায় এল না ওর।
‘এটা জিজ্ঞেস করার জন্য ঘুম থেকে ওঠালে?’ ইভানের গলায় হতাশা।
‘তো কী? আম খাবি না? আর ঘুম থেকে না তুলে জিজ্ঞেস করব কীভাবে?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কাটো আম। খাব।’ বলে আবার শুয়ে পড়ল ইভান। ঘুমের দ্বিতীয় ইনিংস এখনো বাকি ওর।
‘ওমা, এই দেখো, আবার ঘুমাচ্ছে!’ কপট অভিমানের সুরে বললেন ফুফু। ‘তুই উঠবি? সন্ধ্যার সময় ঘুমালে অমঙ্গল হয়। উঠে পড় ঝটপট।’ ইভানের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেন ফুফু। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য হলো ইভান। ও সন্ধ্যার সময় ঘুমালে কার অমঙ্গল হবে, কীভাবে হবে, তা মাথায় ঢুকল না কিছুতেই। উঠে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এল ইভান। দড়িতে টাঙানো তোয়ালেতে মুখ মুছে গ্রিল ধরে দাঁড়াল। বাইরে তাকাতেই হতাশ হলো আবার। কিসের সন্ধ্যা? মাত্র বিকেল হয়েছে। সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক দেরি। শুধু শুধু ঘুমটা ভাঙাল ফুফু।
বিরক্ত হয়ে ডাইনিংয়ে চলে এল ইভান। চেয়ারে বসে ছুরি দিয়ে আম কাটছেন ফুফু। একটু জোরে চেয়ার টেনে বসল ইভান।
‘কয়টা বাজে ফুফু?’
‘সাড়ে ৫টা।’
‘অামাকে ডাকলে কেন শুধু শুধু?’
‘আম খাবি না?’
‘আরে কী অদ্ভুত, কোথাও লেখা আছে নাকি যে ঠিক সাড়ে ৫টায় আম খেতে হবে? এরপর আর খাওয়াা যাবে না?’
‘যাবে।’ আমের বাটি ইভানের দিকে এগিয়ে দিলেন ফুফু। ‘কিন্তু এখন আমার আম খেতে ইচ্ছা করল।’
‘তুমি খেতে।’
নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর মেসেঞ্জারে নিয়মিতই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। কিন্তু দেখা হয়নি এক দিনও। আজ আসায় ভালোই হয়েছে। খাওয়া শেষ করে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। গোটা কয়েক আম সাবাড় করে সোফায় আয়েশ করে বসল রাহাত।
‘একা একা খাব নাকি? এ জন্যই তো তোকে ডেকে তুললাম।’ ফুফুর কথাটা সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলল ইভান। বেচারি সারা দিন একা থাকে বাসায়। তারও নিশ্চয়ই কথা বলতে ইচ্ছা করে। ঘুম থেকে ডেকে তোলার বিরক্তিটা মুহূর্তেই ঝেড়ে ফেলল ও, কিন্তু প্রকাশ করল না। আমে কামড় দিয়ে বলল,
‘ধুর, মিষ্টি না তেমন।’
‘মিষ্টি না মানে? খুবই মিষ্টি আম। তোর জিবে সমস্যা আছে। গপাগপ আম খেয়ে বলছে মিষ্টি না। দেব আরেকটা?’
‘যদিও আমটা অত মিষ্টি না, তারপরও বলছ যখন, দাও।’
‘একটা থাপ্পড় দেব শয়তান কোথাকার! দে, বাটিটা দে এদিকে।’
বাটিটা এগিয়ে দেওয়ামাত্র কলবেল বেজে উঠল। হাত ধুয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল রাহাত। ‘ফুফু, কেমন আছেন?’ স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলল ও।
‘ভালো আছি বাবা, তুমি কেমন আছ? আসো, আম খাও।’ হেসে বললেন ফুফু।
‘বাহ, খুব ভালো সময়ে এসেছি।’ বেসিনের দিকে যেতে যেতে বলল রাহাত।
‘একদম!’ দরজা লাগিয়ে বলল ইভান। ‘কোথাও খাওয়া হলে কি তোর কাছে নোটিফিকেশন যায়? তুই টের পাস কীভাবে?’
‘এটা সাধনা।’ হাত ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ল রাহাত। ‘একটু চেষ্টা, একটু অধ্যবসায় আর একটু আত্মবিশ্বাস থাকলে তুইও পারবি।’ ইভানের জন্য কাটা আমটা নিজের দিকে টেনে নিল রাহাত।
‘আরে, আমার আমটা ওকে দিলে কেন?’ বলল ইভান।
‘তুই না একটু আগে বললি—আম মিষ্টি না। এখন আবার এত দরদ দেখাচ্ছিস কেন? এটা ও খাক। তোকে আরেকটা দিচ্ছি।’ ফুফু বললেন।
‘আমটা যা মিষ্টি, ফুফু! উফ!’ খেতে খেতে বলল রাহাত।
‘এটাই লাস্ট। এরপর আর পাবি না। বাকিগুলো আমি খাব।’
‘দেখা যবে।’
‘তুই হঠাৎ কোত্থেকে?’
‘বাসা থেকে। তোর তো কোনো খোঁজ নাই। তাই ভাবলাম, ডিরেক্ট চলে আসি।’
‘কথাটা বিশ্বাস হলো না।’
‘হেহে, আসলে গতকাল দেখলাম একগাদা আম নিয়ে বাসায় ফিরছেন ফুফা। তাই মনে হলো, দেখা করে যাই!’
‘কী লোভী তুই!’
রাহাত আসায় মনে মনে খুশি হলো ইভান।
নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর মেসেঞ্জারে নিয়মিতই কথা হয়েছে ওর সঙ্গে। কিন্তু দেখা হয়নি এক দিনও। আজ আসায় ভালোই হয়েছে। খাওয়া শেষ করে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। গোটা কয়েক আম সাবাড় করে সোফায় আয়েশ করে বসল রাহাত। চা বানিয়ে দিয়েছেন ফুফু। চায়ে চুমুক দিয়ে রাহাত বলল,
‘তারপর, নতুন স্কুলের কী খবর?’
‘ভালোই। একটা গ্রুপের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। তোকে তো বলেছিলাম। ফুটবলও খেলেছি ওদের সঙ্গে।’
‘তাহলে তো ভালোই।’
‘আমাদের স্কুলের কী অবস্থা?’
‘নতুন কোনো খবর নেই। আগের মতোই আছে।’
‘ক্লাসে কেউ জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে?’
‘করে তো। কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছিস, এটা অনেকেই জানতে চেয়েছিল। তোকে মিস করে সবাই।’
‘তুই মিস করিস না?’
‘আমি মিস করব তোকে? পাগল নাকি? এক ফোঁটা মিস করি না। আমার তো ভালোই হয়েছে। তোর জন্য জায়গা রাখতে হয় না।’ চায়ের কাপ খালি করে বলল রাহাত।
‘তাই, না?’ ইভান জানে এটা রাহাতের মনের কথা নয়।
‘নিচে যাই, চল।’ রাহাত বলল।
‘হ্যাঁ, আমিও একটু পরেই যেতাম ডগেশ রকিকে খাওয়াতে। চল, যাই।’
পলিব্যাগে করে কুকুরদের জন্য খাবার নিল ইভান। তারপর ফুফুকে বলে বাইরে বেরিয়ে এল দুই বন্ধু। তিন রাস্তার মোড়ে এসে শিস দিতেই ছুটে এল ডগেশ। লেজ নাড়তে থাকা কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়েই রকির কাছে গেল ওরা। দুজনের সামনে খাবার রেখে একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের সিঁড়িতে বসল ইভান আর রাহাত। পাশের দোকান থেকে একটা চিপস কিনেছে রাহাত। খুলে খেতে শুরু করল ও। সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে ইভান বলল,
‘এতগুলো আম খেয়ে এখন আবার চিপস খাচ্ছিস? তোর এটা পেট না কুয়া?’
‘বাইরে থেকে তো পেটের মতোই লাগে রে।’ চিপস মুখে দিয়ে কোনোমতে বলল রাহাত।
‘ভেতরে মনে হয় কুয়া।’
‘দে, দেখি। আমিও খাই।’ হাত বাড়িয়ে চিপস নিতে গেল ইভান। একঝটকায় প্যাকেট সরিয়ে নিল রাহাত। ইভান হাত গুটিয়ে ফেলার পর আবার নিজেই এগিয়ে দিল প্যাকেট।
‘একটা ঝামেলা হয়েছে রে।’ চিপস চিবোতে চিবোতে বলল ইভান।
‘আবার কী ঝামেলা?’
‘তারপর আম্মুকে বললাম, আম্মু, ভাইয়া তো ঠিকমতো আসে না। আমার তো পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যস, আম্মু গেল খেপে। টিচার বাদ। আমি এখন কোচিংয়ের গর্বিত ছাত্র।’ উঠে দাঁড়াল রাহাত।
‘ফুফা বাসায একটা টিচার রাখার কথা ভাবছে।’
‘সেকি, এই বয়সে ফুফা টিচারের কাছে পড়বে?’ কয়েক সেকেন্ডের জন্য চিপস খাওয়া থামাল রাহাত।
‘আরে গাধা, ফুফার জন্য না, আমার জন্য।’
‘ও, তাহলে তো ঠিকই আছে।’ চিপস মুখে দিয়ে বলল রাহাত। প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে ইভান টের পেল একটা চিপসও নেই। সব শেষ করে ফেলেছে ওর বন্ধু।
‘সব শেষ করে ফেলেছিস?’
‘আরে আমার কী দোষ? ১০ টাকার প্যাকেটে চিপস থাকে ১৮টা।’
‘তোর কোনো কাজ নাই, বসে বসে প্যাকেটের চিপস গুনিস?’
‘না দোস্ত, সেদিন কোথায় যেন পড়লাম, আমাদের সবার উচিত হিসাব করে খাওয়া। আর কিছু না হোক, চিপসটা আমি হিসাব করে খাই। কম থাকে তো। টিচারের কথা কী যেন বলছিলি?’
‘হ্যাঁ, ফুফা ভাবছে, এই স্কুলে আমার পড়ালেখা হবে না। টিচার বাসায় এসে গাইড করলে ভালো হবে।’
‘ভালো তো। পড়।’
‘না রে। বাসায় টিচারের কাছে পড়তে কেমন যেন লাগে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে আসবে, তার জন্য আবার ওয়েট করা লাগবে। আমার সামনে বসে বসে আমারই বাসার চা–বিস্কুট খাবে, এসব প্যারা লাগে।’
‘কথা ঠিক, মামা।’ পকেট থেকে একটা কিটক্যাট বের করে খেতে খেতে বলল রাহাত। ‘আমার কাছে কোচিংই ভালো। গেলাম কি গেলাম না, সেটা আমার ওপর…কিরে, তাকিয়ে আছিস কেন?’
‘কিটক্যাট খাচ্ছিস, একবার সাধলিও না?’
‘কথার ফ্লোতে ছিলাম তো…খাবি? মুখে দিয়ে দিয়েছি অবশ্য।’
‘খবিশ!’
‘শোন, টিচার যদি রাখেও, তুই বিদায় করে দিবি। আমি তো আমার লাস্ট টিচারটাকে খুব কায়দা করে বিদায় করেছিলাম।’
‘কী করেছিলি যেন?’
‘খুব সোজা। মাঝেমধ্যেই ফোন করে বলতাম, ভাইয়া, আজকে আসবেন না, বাসায় মেহমান কিংবা আমরা বাসায় নেই, বিয়ে খেতে যাচ্ছি—এ রকম।’
‘আন্টিকে কিছু বলত না?’
‘বলবে কীভাবে? আম্মুর ফোন থেকে আমি ওই ভাইয়ার নম্বরটা ব্লক করে দিয়েছিলাম।’
‘তারপর?’
‘তারপর আম্মুকে বললাম, আম্মু, ভাইয়া তো ঠিকমতো আসে না। আমার তো পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। ব্যস, আম্মু গেল খেপে। টিচার বাদ। আমি এখন কোচিংয়ের গর্বিত ছাত্র।’ উঠে দাঁড়াল রাহাত।
‘কিরে?’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘বাসা থেকে ফোন দিচ্ছে। যেতে হবে।’
‘এত তাড়াতাড়ি? থাক আর দশ মিনিট।’
‘আরে না। আমাকে তো সবজি কিনতে পাঠিয়েছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘আয়হায়, তাড়াতাড়ি বাসায় যা। আজকে আন্টি তোকেই বরবটি বানিয়ে তেলে ছেড়ে দেবে।’
‘যাই দোস্ত, আর বোধ হয় দেখা হবে না। আমার কিছু হয়ে গেলে প্লেস্টেশনটা তোর কাছে নিয়ে রাখিস। বদমাইশ ছোট ভাইটা যেন ওইটা হাতে না পায়।’
‘ঠিক আছে। দৌড়া।’ হাসতে হাসতে বলল ইভান।
ইভানও এগোল বাসার দিকে। ডগেশ আর রকি ওকে এগিয়ে দিল একেবারে বাসা পর্যন্ত। কুকুর দুটোকে বিদায় দিয়ে বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল ইভানের ফোন। রুশা কল করেছে। ফোন রিসিভ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল ও।
‘হ্যালো রুশা, কী অবস্থা তোমার?’
‘এই তো। তুমি কোথায়? ইকো হচ্ছে তোমার কথা।’
‘সিঁড়িতে আমি। বাসায় যাচ্ছি।’
‘ও, শোনো না, আমিও বাসায় যাচ্ছি, তোমাদের এদিক দিয়েই তো যাব। নিচে নামবা একটু?’
‘এখন?’
‘এই ধরো পাঁচ মিনিট পর।’
‘বাসায় তো চলেই এসেছিলাম…আচ্ছা, আসো তুমি। বাসার নিচে আসো, আমি দাঁড়াচ্ছি।’
‘ওকে।’
পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নিল না রুশা। বিল্ডিংয়ের সামনেই এসে থামল ওর রিকশা। নিচেই দাঁড়িয়ে ছিল ইভান। এগিয়ে গেল রিকশার দিকে।
‘ওঠো।’ রিকশার এক পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল রুশা।
‘কোথায় যাব?’
‘আগে ওঠো না, বলছি।’ তাড়া দিল রুশা। উঠে বসল ইভান। ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে এগোল ব্যাটারি রিকশা। উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসছিলেন ওর ফুফা। ইভানের সঙ্গে চোখাচোখি হলো তাঁর। রিকশার গতি কাউকে কিছু বলার সুযোগই দিল না। পেছনে একবার তাকাল ইভান, ফুফাও তাকিয়ে আছেন রিকশার দিকে।
‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করল রুশা।
‘ফুফা গেলেন।’
‘আয়হায়। ঝামেলা হবে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘নেমে যাবে? মামা, রাখেন তো…’
‘না, থাক। এখন নেমে আর লাভ নাই। চলো। কিন্তু যাচ্ছি কোথায়?’
‘নুরুল ইসলামের দোকানে।’
‘নুরুল ইসলামের দোকান আবার কোনটা…ওয়েট’, গলা নামিয়ে ইভান বলল, ‘খুন হয়েছে যে লোকটা, উনি?’
‘হ্যাঁ।’
মেইন রোড থেকে বাঁয়ে চলে গেছে একটা গলি। বেশ কিছু অস্থায়ী ফুডকোর্ট বসেছে গলির দুই পাশে। চটপটি, বার্গার, পিৎজা থেকে শুরু করে পানিপুরি-ভেলপুরি, আচারের কার্ট নিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা।
‘ওনার দোকানে গিয়ে কী করব আমরা?’
‘কিছু করব না। দেখব।’
‘কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি নিজেই তদন্তে নেমে গেলা নাকি?’
‘ধরো, অনেকটা ওই রকমই। কোনদিকে যাব?’
‘জি ব্লক... দেখো, এটা কিন্তু আমাদের কাজ না। গল্প–উপন্যাসে এ রকম হয়। কোনো একটা কেস তিন গোয়েন্দা সলভ করে ফেলে। বাস্তবে হয় না। উল্টো ঝামেলায় পড়তে হয়।’
‘ঝামেলার কিছু নেই। আমরা ও রকম কিছু করছি না। জাস্ট কিছু বিষয়ে খটকা লেগেছিল, মিলিয়ে দেখছি। আর আমাকে যে এত কিছু বলছ, শুরুতে তো তুমিও এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলে, করো নাই?’
‘অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি করা আর একেবারে কী যে বলে ওটাকে…সরেজমিনে ঘাঁটাঘাঁটি করার অনেক পার্থক্য।’
‘মামা, সামনে বাঁয়ে রাখেন সাইড করে।’ রিকশাচালককে বলল রুশা। তারপর ছোট্ট করে লাফ দিয়ে নামল রিকশা থেকে। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে তাকাল ইভানের দিকে—
‘কী? বসে থাকবা? নামবা না রিকশা থেকে?’ নেমে দাঁড়াল ইভান। ‘চলো, ওই দিকে।’ পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল রুশাকে।
মেইন রোড থেকে বাঁয়ে চলে গেছে একটা গলি। বেশ কিছু অস্থায়ী ফুডকোর্ট বসেছে গলির দুই পাশে। চটপটি, বার্গার, পিৎজা থেকে শুরু করে পানিপুরি-ভেলপুরি, আচারের কার্ট নিয়ে বসেছে ব্যবসায়ীরা। বেশ জমজমাট জায়গাটা। সন্ধ্যার সময় অনেক মানুষ খেতে আসে এখানে। অস্থায়ী দোকানগুলো পেরিয়ে একটু সামনে এগোল ইভান আর রুশা। গলিটার দুই দিকে দুটি রাস্তা চলে গেছে। ডান পাশেই নুরুল ইসলামের ওয়াফেলের দোকান। ওয়াফেল স্ট্রিট নামের দোকানটার নীল শাটার নামানো।
‘অনেক দিন খোলা হয় না দোকানটা।’ রুশাকে বলল ইভান।
‘কী করে বুঝলে?’ জিজ্ঞেস করল রুশা।
‘শাটারে কী পরিমাণ ধুলা জমেছে, দেখো। রেগুলার খুললে নিশ্চয়ই এত ধুলা থাকত না।’
‘ঠিক।’ একমত হলো রুশা। ‘দোকানটা কিন্তু খুব ভালো জায়গায়। ভালোই কাস্টমার আসত মনে হয়।’
‘তা আসত। এটা এখানকার মোটামুটি পরিচিত দোকান। সবাই চেনে।’
‘ওই যে চায়ের দোকান। চলো, ওখানে গিয়ে চা খাই।’ রুশা কী করতে চাইছে বুঝে ফেলল ইভান। ও চাইছে এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। বুঝতে চাইছে জায়গাটা কেমন। তার মানে কিছু একটা মাথায় আছে ওর।
কোনো এলাকার ধরন জানার জন্য চায়ের দোকান খুব ভালো জায়গা। বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসে এখানে। ইভান আর রুশা একটা ফাঁকা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। দুটো দুধ–চা অর্ডার দিল ইভান। তারপর হতাশ হওয়ার ভান করে বলল, ‘ধুর, এত কষ্ট করে এসে দেখি দোকান বন্ধ। মেজাজ খারাপ হচ্ছে এখন।’
ঝট করে ওর দিকে তাকাল রুশা। চোখাচোখি হলো ইভানের সঙ্গে। যা বোঝার বুঝে নিল ও। দোকানদারের সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করছে ইভান।
‘দোকানটা বন্ধ থাকবে জানলে আসতাম না। এত কষ্ট হলো আসতে।’ আবারও বলল ইভান। ‘কই মামা, চা দিলেন না?’
‘আপনার চা মনে হচ্ছে খুব ভালো।’ দোকানদারকে বলল রুশা। ‘দারুণ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।’
‘চা ভালো না হইলে ডেরেনে ফালায় দিবা।’ ভাব নিয়ে বলল দোকানদার। ‘চা বেচি আজ তিরিশ বৎসর হইল। চোখ বাইন্ধা চা বানাইলে হেইডাও হইব একের চা।’
‘তাই নাকি।’ হেসে ফেলল রুশা। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আসলেই একের চা, মামা।’
‘মেজাজ খারাপ ছিল।’ বলল ইভান। এত দূর এসে দেখি দোকান বন্ধ। এখন আপনার চা খেয়ে মেজাজটা একটু ভালো হলো।’
‘কোন দোকানে আইসিলা তোমরা?’
‘ওই যে, ওইটায়।’ ঘুরে ওয়াফেল স্ট্রিটের বন্ধ দোকানটা দেখাল রুশা।
‘অ। ওই দোকান! ওইডা তো বন্ধ হেই কবত্তেই।’
‘কেন?’
‘দোকানের মালিক মারা গেছে। মার্ডার হইসে। মার্ডার।’
‘বলেন কী!’ আঁতকে উঠল রুশা আর ইভান। ‘কারা করল এই কাজ?’
‘হে আমি কী জানি? দেন, চা খাওয়া হইসে না? কাপ দেন।’ ভ্রু কুঁচকে বলল দোকানদার।
‘ওই দোকানে আমার কিছু টাকা বাকি ছিল।
ভেবেছিলাম আজকে দিয়ে যাব। এখন কী করা যায়?’
‘হের বাসায় গিয়া দিয়া আইসেন। তিন গলি পরেই তো হেগো বাসা।’
‘চিনব কীভাবে?’
‘সুজা হাঁইটা তিনটা গলি পার হইলে দেখবেন একটা দই–ফুচকার দোকান। হেই দোকানের উপরের দুই তলায় হেগো বাসা। ভাবি আছে। ভালো মানুষ। তার কাছে দিবেন। খুশি হইব।’
‘আচ্ছা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আপনার চায়ের মতো আপনিও একের। হেসে বলল রুশা। খুব খুশি হয়ে কাপ ধুতে লাগলেন দোকানদার।
‘কালকে আমরা ওই বাসায় যাব।’ বলল রুশা। রিকশা করে বাসায় ফিরছে ওরা।
‘কিন্তু কেন? যাওয়া ঠিক হবে না। সন্দেহ করতে পারে আমাদের।’
‘সন্দেহ করবে কেন? আমরা যে দোকানে রেগুলার যেতাম, সেই দোকানের লোকটা মারা গেছে। তার বাসায় আমরা যেতে পারি না?’
‘পারি, কিন্তু আমরা তো রেগুলার ওই দোকানে খেতাম না।’
‘তুমি না বললা, মাঝেমধ্যে খেতে আসতা?’
‘মাঝেমধ্যে।’
‘ওই তো। ওটাই রেগুলার ধরে নাও।’
‘আমাদের উদ্দেশ্যটা কী আসলে?’
‘কোনো উদ্দেশ্য নাই। গিয়ে দেখা জাস্ট। লোকটা সম্পর্কে জানা। আমরা ছোট মানুষ। ওনারা পুলিশের কাছে যত অ্যালার্ট হয়ে কথা বলবে, আমাদের সঙ্গে হয়তো তা বলবে না।’
‘আর তখনই আমরা এমন ইনফরমেশন পেয়ে যেতে পারি, যেটা পুলিশ হয়তো পাবে না, রাইট?’
‘একদম। সেটা আমরা বাবাকে জানাব। তার কাজে লাগবে।’
‘বুঝতে পেরেছি।’ মাথা নাড়ল ইভান। ‘আমি এখানেই নেমে যাই। তুমি বাসায় যাও। মামা, একটু রাখেন এখানে।’
‘নামিয়ে দিয়ে যাই তোমাকে?’
‘না, হেঁটেই যেতে পারব। সমস্যা নাই।’ নেমে বলল ইভান।
‘ঠিক আছে। সাবধানে যাও।’
‘আচ্ছা। বাসায় গিয়ে জানিয়ো।’ রিকশা চলতে শুরু করার পর বলল ইভান। ‘ঠিক আছে।’ পেছনে ঘুরে বেশ জোরেই বলল রুশা।
নিশ্চিন্তে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পেল না ইভান। ছবিটার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে ও। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন ফলো করছে ওদের।
বাসায় ফিরে ফুফার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হয়ে নিল ইভান। কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না ফুফা। রাতের খাবার শেষে ফুফু বললেন,
‘রুশা এসেছিল নাকি?’
‘হ্যাঁ।’ ইভান বুঝল এ নিয়ে ফুফুর সঙ্গে কথা বলেছে ফুফা।
‘নিয়ে আসতি বাসায়।’ বললেন ফুফু্। ‘আম খেয়ে যেত।’
‘তুমি আছ তোমার আম নিয়ে।’ হেসে বলল ইভান। ‘আমি গেলাম আমার ঘরে।’
‘ওমা, আম খাবি না?’
‘না।’ ঘরে যেতে যেতে বলল ইভান।
*
পরদিন স্কুলে গিয়ে নিজের নির্ধারিত সিটে বসল ইভান। রাতুলের পাশের এই সিটটা এখন ওর জন্যই খালি থাকে। সিটে বসামাত্র ওকে খোঁচা মেরে রাতুল বলল,
‘কিরে, খুব চিল করলি, তাই না?’
‘কোথায় চিল করলাম?’
‘কিচ্ছু জানো না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।’ ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল রাতুল। লক খুলে একটা ছবি বের করে দেখাল ইভাকে। চমকে গেল ইভান। ও আর রুশা গতকাল হাঁটছিল ওয়াফেল স্ট্রিটের ওই দিকে। তখন ছবি তুলেছে কেউ।
‘এই ছবি তুই কোথায় পেলি? কে তুলল?’
‘বলেছিলাম না, আমাদের বিশাল নেটওয়ার্ক। চিন্তা করিস না। কোনো নেগেটিভ উদ্দেশ্যে তোলে নাই, তোকে চমকে দেওয়ার জন্য তুলেছে। বিশ্বস্ত ছেলে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস।’
নিশ্চিন্তে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পেল না ইভান। ছবিটার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে ও। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন ফলো করছে ওদের।
‘কী দেখছিস এত মন দিয়ে?’ রাতুলও তাকাল ছবিটার দিকে।
‘আমাদের ঠিক পেছনে দোকানটার সামনে দেখ, একটা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘এই ছেলেটাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ওর কারণেই আমি আজকে এই স্কুলে।’
‘বলিস কী? কে এই ছেলে?’
‘ওর নাম জিকো।’
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619