‘কী রে, কী দেখছিলি?’ তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জিকোকে জিজ্ঞেস করলেন মামা।
‘ধুরো মামা।’ বলল জিকো। তোয়ালে ঢেকে দিয়েছে মামার চোখ–মুখ। এই সুযোগে চোখের পলকে মামার ফোনের গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এল জিকো। ‘তোমার ফোনটা যা-তা,’ বলে ওপেন করল ইউটিউব।
‘যা-তা মানে?’ তোয়ালে সরিয়ে বললেন মামা।
‘এত স্লো। ইউটিউব ওপেন হতে হতে তোমার গোসল শেষ হয়ে গেছে।’
‘আরে এই কেবিনটায় নেটওয়ার্কে খুব ঝামেলা।’
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু তোমার ফোনটাও স্লো। অ্যাপ ওপেন হইতে অনেক সময় নেয়।’
‘কথা খারাপ বলিস নাই। ফোনটা একটু স্লো-ই হইসে। দেখি, আরেকটা ফোন কিনব। আইফোন ১৫ কিনব এবার।’
‘বলো কী! ওইটা কিনতে তো অনেক টাকা লাগবে।’
‘আরে ব্যাটা, ফকির নাকি আমি? শখের একটা ব্যাপার আছে না? দে, ফোনটা দে।’
‘আরেকটু থাক না আমার কাছে। গানটান শুনি।’
‘না, কাজ আছে আমার। জরুরি কাজ।’
‘মামা, প্লিজ, দাও না।’
‘আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর। আমি কয়েকটা কল সেরে নিই।’
‘আচ্ছা। আমার ফোনটা একটু চার্জে দিয়ো মামা।’ ফোনটা মামার হাতে দিয়ে বলল জিকো।
‘সুযোগ পেয়ে ভালোই অর্ডার করছিস। আমি যখন হাসপাতালে থাকব, তখন তো তোর ছায়াও দেখা যাবে না হাসপাতালে। বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াবি।’
‘কী কও না কও মামা। আমি জিকো বেয়াদব হইতে পারি, অকৃতজ্ঞ না। একবার কেউ আমার উপকার করলে তার লগে জীবনে কাপঝাপ করি না।’
‘তাই নাকি?’
‘একদম।’
‘তার নমুনা তো দেখলাম।’ মুখে আফটার শেভ ঘষে গায়ে শার্ট জড়িয়ে বললেন মামা। আফটার শেভের ঝাঁজালো একটা গন্ধ ধাক্কা দিল জিকোর নাকে। ‘তোর যে বন্ধু তোকে দেখতে এল, তাকেই তো ফাঁসিয়ে দিলি।’
জিকোর মনে হলো, এসি থেকে হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিল ওকে। ঘাড়ের পাতলা চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল ঠান্ডায়। বিস্মিত হয়ে মামার দিকে তাকাল জিকো। মনে মনে বলল, মামা কী করে বুঝল!
‘কী রে?’ উল্টো পাশের বিছানায় বসে বালিশটা টেনে বলল মামা। ‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আরে, মজা করলাম।’
চুপ করে রইল জিকো। কথাটা যে মামা মজা করে বলেননি, তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে সে। হঠাৎ মনে হলো, মামাকে ঠিক চিনতে পারছে না ও। কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে লোকটাকে। মামার দিকে তাকাল জিকো। কোনো এটা নম্বর খুঁজছেন ফোনে। একটু পর খুঁজে পেয়ে কল দিলেন। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠলেন মামা। দরজা খুলে চলে গেলেন কেবিনের বাইরে। কান খাড়া করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল জিকো। কিন্তু এসির ঘরঘর শব্দ ছাড়া তেমন কিছুই শুনতে পেল না। একবার দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলেন মামা। ‘তুই কি বাথরুমে যাবি এখন?’ জিজ্ঞেস করলেন চেঁচিয়ে। মাথা নাড়ল জিকো, যাবে না। অস্থির লাগছে ওর। মাথায় চিন্তার ঝড়! যে করেই হোক, মামার ফোনটা একবার হাতে পেতে হবে ওকে। গোপনে গোপনে কী ঘটাচ্ছে মামা, সেটা জানা দরকার।
দরজা খোলার শব্দে নড়েচড়ে বসল জিকো। মুখে হাসি নিয়ে নার্স এসে ঢুকলেন কেবিনে। ‘কী অবস্থা তোমার?’ বলে বেডের পাশের টেবিলটায় রাখা ওষুধগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করলেন তিনি।
‘এই তো, ভালো।’ বলল জিকো।
‘ব্যথা আছে পায়ে?’
‘সে রকম লাগছে না।’
‘ভালো খবর।’
‘আচ্ছা সিস্টার, আমার ফোনটা একটু দেবেন? ওই পাশে চার্জে আছে।’
‘দিচ্ছি।’
হেঁটে গিয়ে চার্জার থেকে ফোনটা খুলে এনে জিকোর হাতে দিলেন নার্স। নার্সকে ধন্যবাদ দিল জিকো।
দরজা খুলে বাসায় ঢুকতেই ইভান বুঝে ফেলল, পরিস্থিতি সুবিধার নয়। ড্রইংরুমে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ফুফু আর ফুফা।
‘এত অল্প বয়সে বাইক নিয়ে ঘোরাফেরা কোরো না ভাই। প্রতিদিনই বাইক অ্যাকসিডেন্ট করা প্রচুর রোগী আসে হাসপাতালে।’ জবাব দিল না জিকো। নার্সের কথা শুনতে ভালো লাগছে না ওর। পায়ে ব্যথা পাওয়ার পর থেকে যে-ই সুযোগ পাচ্ছে, জ্ঞান দিচ্ছে। অ্যাকসিডেন্ট একবার হয়ে গেলে সবাই জ্ঞানের বাক্স নিয়ে হাজির হয়। এটা কেন করলা, ওইটা কেন করলা না…যত্তসব। আরে ব্যাটা জিনিসটাই তো অ্যাকসিডেন্ট। এটা নিয়ে এত কথা বলে লাভ আছে কোনো? বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল জিকো।
‘আমার কথা ভালো লাগছে না, তাই না? ভালো না লাগারই কথা।’ হেসে বললেন নার্স। পায়ের ব্যান্ডেজ ঠিক আছে কি না দেখে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন। বললেন, ‘আমার কাজও শেষ।’ চুপ করে রইল জিকো। নার্স বললেন,
‘আজ স্যার আসবেন রাউন্ডে। আমার মনে হয় দুই–এক দিনের মধ্যেই তোমাকে রিলিজ দিয়ে দেবে।’ রোগীর চোখেমুখে মুক্তির আনন্দ চোখে এড়াল না নার্সের। ‘ওরে, কী খুশি! অত খুশি হওয়ার কিছু নাই, স্যার।’
‘কেন?’
‘রিলিজ পেয়েই মনে কোরো না বাইক চালাতে পারবে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটা শুরু করতে অনেক সময় লাগবে তোমার। আর যদি ঠিকমতো মেনে না চলো, তাহলে লম্বা সময়ের জন্য ক্ষতি হয়ে যাবে।’
‘ও আচ্ছা।’ পলকেই দমে গেল জিকো।
দরজার কাছাকাছি গিয়ে আবার এলেন নার্স। বললেন,
‘কেন তোমাকে বাইক নিয়ে এত কথা বলি প্রতিদিন, জানো?’
‘আপনি তো বলবেনই। সবাই বলে। এটা না বোঝার কী আছে? এগুলো শুনতে ভালো লাগে না, এই আরকি।’
‘আমার ছোট ভাই মারা গেছে বাইক অ্যাকসিডেন্টে। এ জন্য বলি।’
বাক্রুদ্ধ হয়ে গেল জিকো। ব্যাপারটার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না সে। ‘ঠিক আছে, বিশ্রাম নাও, দরকার হলে বোলো।’ বলে ঝট করে ঘুরে বেরিয়ে গেলেন নার্স।
*
তিন রাস্তার মোড়ে আসতেই রকিকে দেখতে পেল ইভান। ওকে দেখেই লেজ নাড়তে নাড়তে ছুটে এল রকি। ঝুঁকে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ইভান। পকেট থেকে বিস্কুটের প্যাকেট খুলে বিস্কুট বাড়িয়ে দিল রকির দিকে। মাথা নিচু করে বিস্কুট খেতে শুরু করল কুকুরটা। ইভান দেখল, ওর ক্ষতগুলো শুকিয়ে এসেছে প্রায়। এ কয়দিন দুই বেলা করে ড্রেসিং করেছে ও। বেশ দ্রুত সামলে নিয়েছে কুকুরটা। পকেট স্যানিটাইজার বের করে হাত জীবাণুমুক্ত করে নিল ইভান। তারপর হাঁটতে শুরু করল বাসার দিকে। রকিও হাঁটছে ওর পেছন পেছন। একটু এগোতেই তীক্ষ্ণ শিস বাজাল ইভান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চারপায়ে ছুটে এল ডগেশ। শিস বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলল ওরা তিন বন্ধু—ডগেশ, রকি আর ইভান।
দরজা খুলে বাসায় ঢুকতেই ইভান বুঝে ফেলল, পরিস্থিতি সুবিধার নয়। ড্রইংরুমে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন ফুফু আর ফুফা।
‘ইভান!’ গম্ভীর ভঙ্গিতে ডাকলেন ফুফা। দরজার ছিটকিনি আটকে তাঁর দিকে তাকাল ও।
‘জি ফুফা।’
‘কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে তুমি। নতুন একটা স্কুল ঠিক করেছি। ওরা ভর্তি করবে তোমাকে।’
‘আচ্ছা।’ মাথা নিচু করে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিল ইভান।
‘কী রে!’ অবাক হলেন ফুফু। ‘কোন স্কুল, কোথাকার স্কুল কিছুই তো জিজ্ঞেস করলি না। কী ব্যাপার?’
‘একটা হলেই হলো। ফুফা নিশ্চয়ই সব খোঁজখবর নিয়েছেন। উনি যেখানে বলবেন, সেখানেই পড়ব। কোনো অসুবিধা নেই।’
হাত–মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসল ইভান। বই নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর ছুটে গেল মনোযোগ। ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জারে রাহাতকে নক করল।
‘ফুফা নতুন স্কুল ঠিক করেছে।’
‘কীহ!’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল রাহাত।
‘কাল যাব নতুন স্কুলে।’ অনেকক্ষণ ধরে তিনটা ডটের ওঠানামা দেখল ইভান। বড় একটা কিছু টাইপ করছে রাহাত। মেসেজটা আসার অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু কয়েক মিনিটেও কোনো মেসেজ এল না। তিনটা ডট তখনো ওঠানামা করেই যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর এল রাহাতের মেসেজ। শুধু তিনটা মন খারাপের ইমো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভান। ও জানে, অনেক কিছুই লিখতে চেয়েছিল রাহাত, গুছিয়ে উঠতে পারেনি। পারার কথাও নয়। ও নিজেও কি পারবে গুছিয়ে লিখতে? অন্য স্কুলে যাওয়ার কথা দুজনের কেউই কোনো দিনই ভাবেনি। একসঙ্গে কত স্মৃতি দুজনের। বৃষ্টিতে ভিজে স্কুলের মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট ম্যাচে একসঙ্গে ব্যাটিং ওপেন করা, এদিক–সেদিক ঘুরতে যাওয়া, ছোট ছোট খুনসুটি, খেলা-মুভি-গান নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা, একসঙ্গে ফিফা খেলা সবই হয়তো হবে। কিন্তু দুজনের স্কুল তো আলাদা। আলাদা সিট। রাহাতের ব্যাগের পাশে আর দেখা যাবে না ইভানের ব্যাগ। একজনের দেরি হলে জায়গা রাখবে না অন্যজন। বারান্দা দিয়ে আসা বাতাস আর কখনো একসঙ্গে ছুঁয়ে যাবে না দুজনকে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে একটা পাখি দেখে কনুইয়ের খোঁচা দেবে না একে অপরকে। টিফিনে একটা শিঙাড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি করা হবে না আর। ছুটির পর একসঙ্গে বাসায় ফেরার সময় একটা ইটের টুকরো লাথি মারতে মারতে নিয়ে যেতে পারবে না অনেক দূর। এমন সব এলোমেলো ভাবনায় মন ভারী হয়ে উঠল ইভানের। নোটিফিকেশনের ভোঁতা শব্দে আবার ফোন হাতে তুলে নিল ও। রাহাত লিখেছে, ‘দোস্ত, তোকে ছাড়া আমি কীভাবে ক্লাস করব প্রতিদিন?’ মেসেজটা দেখেই হু হু করে উঠল ইভানের বুক। ওর জীবনটা এ রকম হয়ে গেল কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করল ইভান। কোনো জবাব নেই ওর কাছে।
খুব মন খারাপ হলে রাহাতকেই কল দেয় ইভান। কিন্তু এখন তো রাহাতেরও মন খারাপ। ওকে কল দিয়ে মন খারাপের ওজন আর বাড়াতে চাইল না। কল দিল বাবাকে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর কল ধরলেন ইভানের বাবা।
‘কী বাবা? কী খবর তোমার?’
‘ভালো। তুমি কেমন আছ?’
‘আছি ভালো।’
‘ব্যস্ত?’
‘ব্যস্ত তো বটেই। এখন এখানে কাজের সময় না?’
‘ও হ্যাঁ। তাহলে রাখি।’
‘শোনো, নতুন স্কুল নিয়ে মন খারাপ কোরো না। এক স্কুলে এত দিন পড়ার কী আছে?’
‘কী বলো বাবা, এখানেই তো আমার সব বন্ধু। বন্ধুদের ছেড়ে যেতে হবে। খারাপ লাগছে আমার।’
‘আরে বোকা, বন্ধুদের আবার ছাড়া যায় নাকি? একবার যে বন্ধু হয়, সারা জীবন সে বন্ধুই থাকে। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলের কী সম্পর্ক? স্কুলের বাউন্ডারি পার হয়ে অনেক দূরে গেছে বলেই তো সম্পর্কটা বন্ধুত্ব।’
‘হুঁ।’
‘এই স্কুলে তো অল্প কয়েকটা মাস। তারপর তো তোমার পরীক্ষাই হয়ে যাবে। পরীক্ষার পর তোমাকে এখানে নিয়ে আসব।’
‘আচ্ছা।’
‘দেখি, এই স্কুলে কয়টা বন্ধু বানাতে পারো তুমি। প্রত্যেক বন্ধুর জন্য আছে বিশেষ অফার।’
‘ধুর, এভাবে হয় নাকি? তুমি মোবাইল কোম্পানির মতো কথা বলছ, বাবা।’
‘শোনো, তোমার এই স্কুলটা আগের স্কুলের মতো নয়। অনেক রকম ছেলে আছে এখানে। এদের সঙ্গে যদি মানিয়ে চলতে পারো, তাহলে পরে তোমার অনেক সুবিধা হবে।’
‘তুমি কিন্তু অন্য বাবাদের মতো জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছ।’
‘তাই? আচ্ছা, তাহলে এখন একটা জোক বলি, নাকি? শোনো, এক ডাক্তারের কাছে এসেছে এক রোগী…’
জীর্ণ শরীরের একজন লোক এসে ইশারা করল ইভানকে। লোকটার পেছন পেছন হাঁটা দিল ইভান। জলিল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জলিল মিয়া বললেন, ‘শুনো, তুমি তো ভালো স্কুল থেইকা আইসো। সাবধানে থাইকো।’
‘বাবা প্লিজ! এই এক জোক আর না। জোক বলতে হবে না। আমার মন ভালো এখন। তুমি কাজ করো।’
‘ওকে, বাই।’
বাবার সঙ্গে কথা বলে বেশ হালকা লাগছে ইভানের। ও ঠিক করল, নতুন স্কুলটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবে। ধরা যাক, এটা একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চার। ‘দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি’। নামটা চিন্তা করে নিজেই হেসে ফেলল ফিক করে।
ফুফার পেছন পেছন স্কুলের গেটে এসে দাঁড়াতেই মন খারাপ হলো ইভানের। এ স্কুলের কথা অনেক শুনেছে ওরা। এলাকার কুখ্যাত আর ভয়ংকর সব ছেলে পড়ে এই স্কুলে। মারামারিতে কেউ পারে না ওদের সঙ্গে। ভয়ে এই স্কুলে খেলতে আসতে না চায় না অন্য স্কুলের কোনো টিম। এলেও জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারে না কেউ। স্কুলটা থেকে কিছুটা দূরে মিরপুরের চিড়িয়াখানা। তাই অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরা মজা করে স্কুলটাকেই চিড়িয়াখানা বলে। সবাই কী কী বলে খ্যাপাবে, তা ভেবেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল ইভানের। সবচেয়ে বড় কথা, এই স্কুল ডে শিফটের। বিকেলে খেলা কঠিন হবে ওর জন্য। কিন্তু কিছু করার নেই। কোনোমতে কয়েকটি মাস কাটিয়ে দিতে হবে। ফুফার সঙ্গে স্কুলের হেডস্যারের রুমে ঢুকল ও। হেডস্যার ওকে দেখেই পান চিবাতে চিবাতে বললেন, ‘দেইখা তো ভালো ছেলেই মনে হয়। রোল কত ছিল আগের স্কুলে?’
‘১৩।’
‘ছাত্র তো খারাপ না।’
‘জি স্যার। ও পড়াশোনায় ভালো। আরেকটু মন দিলে প্লেসে চলে আসত।’ ফুফা তড়িঘড়ি করে বললেন।
‘বুঝছি। আজকাল অবশ্য ভালো ছাত্রগুলাও বদমাইশ। মাইর বন্ধ হওয়ায় পোলাপান আর ভয় পায় না। দিন দিন বদমাইশ হইতেসে।’
‘ও অবশ্য এ রকম না। খুব ভালো ছেলে।’
‘দেখা যাক। তুমি যাও, ক্লাস শুরু করো। কেউ ঝামেলা করলে বলবা আমারে, ঠিক আছে?’
‘জি স্যার।’
‘ক্লাস টিচাররে বলবা, তোমার নামটা খাতায় তুলতে। এই জলিল মিয়া, ওরে টেনের ক্লাসটা দেখায় দাও।’
জীর্ণ শরীরের একজন লোক এসে ইশারা করল ইভানকে। লোকটার পেছন পেছন হাঁটা দিল ইভান। জলিল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জলিল মিয়া বললেন, ‘শুনো, তুমি তো ভালো স্কুল থেইকা আইসো। সাবধানে থাইকো।’
‘কেন?’ ইভানের কণ্ঠে কৌতূহল।
‘পুলাপান বদ। তুমারে লাড়া দিতে পারে।’
‘লাড়া মানে?’
‘মানে, ঝামেলা করতে পারে আরকি।’
‘ও আচ্ছা।’
টেনের ক্লাসরুম থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে আসছে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করল ইভান। প্রথম এক সপ্তাহই চ্যালেঞ্জ, তারপর আর ঝামেলা হওয়ার কথা না। ভাবল ও। ইভান ক্লাসে ঢুকতেই কোলাহল কিছুটা কমে এল। বেশ কয়েকজন আগ্রহী হয়ে তাকাল ওর দিকে। ইভানও তাকাল। একপলকে দেখে অধিকাংশ ছাত্রকেই ওর চেয়ে বয়সে একটু বড় মনে হলো। সবার উদ্দেশে হাত নেড়ে ইভান বলল, ‘হাই।’
কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না কেউ। তারপর বেশ কয়েকজন মিলে হাসতে শুরু করল জোরে জোরে। অস্বস্তি বোধ করল ইভান। দুই বেঞ্চের মাঝখান দিয়ে হেঁটে পেছন দিকে চলে গেল ও। বসে পড়ল একেবারে পেছনের বেঞ্চে। কেউ কেউ যে ওকে নিয়েই কানাঘুষা করছে, বুঝতে বাকি রইল না। ‘নতুন মুরগি’ কথাটা বলল কে যেন। পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে খাতা বের করল ইভান। উদ্দেশ্য, এলোমেলো আঁকিবুঁকি করে সময় কাটানো। পাশ থেকে লম্বা একটা ছেলে ওর সামনে বেঞ্চে টোকা মারল। মুখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাল ইভান। ছেলেটা বলল,
‘পিঙ্ক ফ্লয়েড শোনো নাকি?’
‘হ্যাঁ, শুনি।’ বেশ অবাক হলো ইভান। প্রশ্নটা আশা করেনি সে।
‘ভাব নেওয়ার জন্য না সিরিয়াসলি শোনো?’
‘সিরিয়াসলি শুনি। ভাব নেওয়ার জন্য শুনব কেন?’
‘উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার, ডার্ক সাইড অব দ্য মুন, দ্য ওয়াল এই সব ছাড়া একটা আন্ডাররেটেড গানের নাম বলো, তাহলে বুঝব তুমি সিরিয়াসলি শোনো।’
‘আমি তো পরীক্ষা দিতে বসি নাই।’
‘বুঝছি। তুমিও ভাব নেওয়ার জন্য শোনো। ব্যাপার না।’
‘জুলিয়া ড্রিম।’
‘এটা কী?’
‘পিঙ্ক ফ্লয়েডের একটা গান। খুব সুন্দর।’
‘বুঝছি। তুমি সিরিয়াসলি ফ্লয়েড শোনো। ভাব নেওয়ার জন্য শোনো না।’
‘ভাব নেওয়ার জন্য গান কে শোনে?’
‘আমি শুনি।’ ফিক করে হেসে ফেলল ছেলেটা। ইভানও হাসল। ছেলেটাকে ভালোই লাগল ওর।
‘আমি রাতুল। তুমি?’
‘ইভান।’
‘সামনে জায়গা আছে। আসো, সামনে আসো।’ নিজেই ব্যাগটা টেনে সামনের বেঞ্চে রাখল রাতুল নামের ছেলেটা। ইভান বেরিয়ে সামনের সিটে এসে বসল।
‘নতুন কেউ এলে তুমি কি সবাইকে পিঙ্ক ফ্লয়েড নিয়ে প্রশ্ন করো?’ বলল ইভান।
‘সবার খাতায় পিঙ্ক ফ্লয়েডের লোগো আঁকা থাকে না।’ মুচকি হাসল রাতুল। ওর খাতায় যে লোগো আছে, ভুলেই গিয়েছিল ইভান। ‘ছেলেটার অবজারভেশন পাওয়ার তো ভালো।’ ভাবল ও। একটু পরই স্যার চলে এলেন ক্লাসে। রোলকল শেষে স্যার বললেন, ‘নতুন ছেলে কে এসেছ? এদিকে আসো।’ দ্রুত স্যারের কাছে চলে গেল ইভান। নাম এন্ট্রি করতে করতে স্যার বললেন,
‘টিসি কেস?’
‘জি স্যার।’
‘ফেল করেছ? নাকি প্রেমঘটিত ব্যাপার?’
‘এগুলো কিছু না স্যার। সিনিয়রদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। ডিসিপ্লিন ইস্যু, স্যার।’
‘এখানে এ রকম কিছু যেন করতে না দেখি। ঝামেলা করলে একদম হাড্ডি টাইট করে ফেলব। যাও, জায়গায় গিয়ে বসো।’
নিজের বেঞ্চে ফিরতে গিয়ে মেজাজ খারাপ হলো ইভানের। আগের স্কুলে জমির কত ভালো ব্যবহার করতে ছাত্রদের সঙ্গে। আর এই স্যারের কথা বলার কী টোন! হাড্ডি টাইট করে দেবে। হাড্ডি যথেষ্ট টাইট আছে। এর বেশি টাইট করতে গেলে জয়েন্ট ছুটে যাবে।
‘স্যারটা প্যারা।’ ইভান বসতেই বলল রাতুল।
‘বুঝতে পারছি।’
ছুটির ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল ওরা। স্কুল থেকে বেরিয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করল রাতুল। ইভানও জোরে হাঁটতে পারে। রাতুলের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে সমস্যা হলো না ওর। একটা কলোনির মধ্যে ঢুকে গেল ওরা।
শুধু এই স্যার না, ইভানের মনে হলো প্রতিটি স্যারই বেশ প্যারা দেবে ওকে। পড়ানোর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই এই স্যারদের। কোনোমতে ক্লাসটা পার করে দিতে পারাটাই স্যারদের উদ্দেশ্য। এই স্কুলে নিয়মিত ক্লাস করা কঠিন হবে—ভাবল ও। পড়ালেখা যা করার নিজের মতো করতে হবে।
তবে রাতুল ছেলেটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে। প্রথম দিনেই এ রকম সমমনা একজনকে পাবে, তা আশা করেনি ইভান। বন্ধুবান্ধব হয়ে গেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে স্কুলেও আনন্দে সময় কাটানো যায়।
‘ছুটির পর তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’ শেষ পিরিয়ডে বলল রাতুল। ইভানের মনে হলো, প্রথম দিনে এটা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।
‘আজকে না। বাসায় যেতে হবে আমাকে।’
‘উঁহু। আজকেই। আজকে প্রথম দিন। প্রথম দিনটা মজার হলে তোমার আজীবন মনে থাকবে।’
‘আমার মেমোরি খারাপ না। এমনিতেই মনে থাকবে।’
‘বাই এনি চান্স, তুমি কি ভয় পাচ্ছ নাকি?’
‘আরে না। ভয় পাব কেন? আমি বলেছি স্কুল শেষে সোজা বাসায় যাব।’
‘সে তো সবাই যাবে। আমিও যাব। যাওয়ার আগে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তুমি মজা পাবা। ১০-১৫ মিনিট লাগবে।’ রাতুলের জোরাজুরিতে ইতস্তত করল ইভান। ব্যাপারটা পছন্দ হলো না ওর। কিন্তু প্রথম দিনেই ওকে মুখের ওপর ‘না’ বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারল না ও। ব্যাপারটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল ও। তারপর বলল,
‘আচ্ছা, যাব। কিন্তু বেশি দেরি করা যাবে না।’
‘দেরি হবে না। জাস্ট যাব আর আসব।’ আশ্বাস দিল রাতুল।
ছুটির ঘণ্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল ওরা। স্কুল থেকে বেরিয়েই দ্রুত হাঁটতে শুরু করল রাতুল। ইভানও জোরে হাঁটতে পারে। রাতুলের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে সমস্যা হলো না ওর। একটা কলোনির মধ্যে ঢুকে গেল ওরা। এই দিকটায় কখনো আসেনি ইভান। এখানে যে এ রকম একটা কলোনি আছে, জানা ছিল না ওর। দুপাশে গাছপালা প্রচুর। বেশ একটা মফস্সল শহরের মতো ব্যাপার আছে এলাকাটায়। ভালো লাগল ইভানের। একেবারে পেছন দিকে চলে এল ওরা। জায়গাটা বেশ নোংরা। মনে হচ্ছে এদিকে কেউ আসে না সচরাচর। ‘আমরা যাচ্ছি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘চিড়িয়াখানায়।’
‘মানে!’
‘হ্যাঁ, এখান দিয়ে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার গোপন পথ আছে।’
‘কিন্তু এখন চিড়িয়াখানায় যাব কেন? খাঁচার মধ্যে প্রাণীদের আটকে রাখা ব্যাপারটা আমার পছন্দ না।’
‘সন্ধ্যাবেলা চিড়িয়াখানায় ঢুকেছ কখনো?’
‘না।’
‘আজকে ঢুকবা। অন্য রকম ফিল।’
আইডিয়াটা একেবারে খারাপ লাগল না ইভানের। কিন্তু এটাও বুঝল, এখানে এসে ভুল করেছে ও। রাতুল বলেছিল ১০-১৫ মিনিট লাগবে। মিথ্যা কথা। মাত্রই ও বলল, সন্ধ্যাবেলা চিড়িয়াখানা দেখার কথা। অন্য কোনো মতলব আছে কি না, ধরতে পারল না ইভান।
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ অনেকটা সামনে এগিয়ে গেছে রাতুল। ‘আসো তাড়াতাড়ি।’ পা বাড়াল ইভান। একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল ওরা। অন্ধকার হলে তারপর এগোবে রাতুল। মাথার ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে মশার ঝাঁক। ইভান বলল, ‘তুমি তো কথা রাখলা না। তোমাকে বললাম সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরব। এখানেই তো সন্ধ্যা হয়ে গেল।’ ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলল রাতুল। প্রচুর পাখি কিচিরমিচির করছে। ঘরে ফিরছে পাখিরা। দৃশ্যটা ইভানকে দেখতে বলল ও। ইভানের মনে অন্য চিন্তা। পাখি ঘরে ফিরছে, এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না ও। নিজে কখন ফিরবে, ভাবছে সেটা নিয়ে।
আলো কমে আসামাত্র দেয়াল টপকে অন্য পাশে গিয়ে নামল রাতুল। ইভানও নামল রাতুলের দেখাদেখি। দুপাশে গাছপালা, মাঝখানে সরু রাস্তা ধরে এগোচ্ছে ওরা। পাখি ছাড়াও নানা রকম পশুর ডাক ভেসে আসছে। গা ছমছম করে উঠল ইভানের।
‘ভয় লাগছে?’ জিজ্ঞেস করল রাতুল।
‘আরে না।’ উড়িয়ে দিতে চাইল ইভান। ‘আর কত দূর?’
‘এটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। পেছন দিক দিয়ে ঢুকেছি।’
‘চিড়িয়াখানায় যাব না?’
‘আজকে না। আরেক দিন।’
‘তাহলে?’
‘ইশশশ!’ মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল রাতুল। দর্শনার্থীদের বসার জন্য একটা ছাউনি আছে। অন্ধকার। সেদিকে এগোল রাতুল। ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগছে না ইভানের। কিন্তু মুখ ফুটে বলল না ও। শুকনো পাতা সশব্দ মাড়িয়ে এগিয়ে চলল ও। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কী একটা প্রাণী বিকট শব্দে ডাকছে একটু পরপর। শেয়াল না হায়েনা, ঠিক বুঝতে পারল না ইভান। টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে ছাউনিতে। সিমেন্টের বেঞ্চে বসে পড়ল রাতুল। ইভানকেও বলল বসতে। দাঁড়িয়ে।
‘দেরি হয়ে গেছে অনেক। বাসায় যাওয়া লাগবে আমার।’
‘আরে দাঁড়াও না, মাত্রই তো এলে।’
‘তুমি যাবা এখন? না গেলে থাকো। আমি চলে যাচ্ছি।’ বলে উল্টো দিকে হাঁটা দিলে ইভান।
‘আরে শোনো, অ্যাই ইভান। আ আ…’ রাতুলের চিৎকার শুনে আবার ঘুরল ইভান। বাঁ চোখটা ঢেকে ঝুঁকে বসে আছে রাতুল। কাতরাচ্ছে ব্যথায়। ছুটে এল ইভান।
‘কী হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না। চোখে কী যেন পড়েছে।’
‘দেখি, তাকাও তো।’
‘তাকাতে পারছি না।’
‘আরে, তাকাও। কিচ্ছু হবে না। হাত সরাও।’ মাথা পেছন দিকে এলিয়ে দিয়েছে রাতুল। চোখে কী হয়েছে, দেখার জন্য ঝুঁকে ওর চোখের দিকে তাকাল ইভান। আস্তে আস্তে বাঁ হাত সরাল রাতুল। হাতটা পুরোপুরি সরাতেই আতঙ্কে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল ইভানের। লাফ দিয়ে পেছনে সরে গেল ও। রাতুলের বাঁ চোখের কোটর শূন্য, চোখটাই নেই।
ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বেরোল না ইভানের। বিশ্রীভাবে হাসছে রাতুল। ইভানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ও। হাতের দিতে তাকিয়ে পুরো পৃথিবী দুলে উঠল ইভানের। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, কোটরশূন্য রাতুলের হাতে একটা চোখ।
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619