প্রচণ্ড শব্দে বিদ্যুৎ চমকালো আকাশে। কানে তালা লেগে গেল ইভানের। ভয়ংকরভাবে কেঁপে উঠল বুক। একঝলকে দেখতে পেল, চোখটা হাতে নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে রাতুল। ঘুরে দৌড় দেওয়ার শক্তি পেল না ইভান। যেন বরফ-পানি খেলায় ‘বরফ’ বলে ওকে ছুঁয়ে দিয়েছে কেউ। পা দুটো টেনে ধরে রেখেছে কোনো শেকল। নাড়াতেই পারছে না। বহুকষ্টে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল কংক্রিটের তৈরি বেঞ্চের হেলান দেওয়ার অংশটা। রাতুল এগিয়ে আসছে। আশপাশ থেকেও পাতা মাড়িয়ে আসছে কেউ। সেদিকে তাকাতেও পারল না ইভান। টের পেল পেছন থেকে এগিয়ে আসছে কিছু একটা। বেঞ্চটা আরও শক্ত করে ধরল ইভান। অদ্ভুতভাবে চিৎকার করে চোখটা ওর মুখের সামনে ধরল রাতুল। আবছা অন্ধকারে ভয়ংকর লাগছে কোটরশূন্য বাঁ চোখটা। পেছনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ইভান। ঠিক তখনই পেছন থেকে হইহই করে ওদের ঘিরে ধরল কয়েকজন। লাফালাফি শুরু করল ওরা। পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ইভান। একটু পর মোবাইলের টর্চ লাইটের আলো এসে পড়ল ইভানের চোখে। হঠাৎ আলোর ঝলকানি সহ্য করতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল ইভান। কেউ একজন বলল,
‘কিরে, এ দেখি ভয় পায় না।’
‘কী বলিস, দেখ, ঘেমে গেছে ভয়ে।’
‘নাহ, খেলাটা জমল না। কিরে, ভয় লাগে নাই তোর?’
‘তোমরা কারা?’ আলো এড়িয়ে কোনোমতে জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘আমরা ভূত।’ বলে নিজেরাই হাসল জোরে জোরে।
‘ও আচ্ছা।’ বলল ইভান। সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিছুটা।
‘বলেছিলাম না, ও একটা জিনিস।’ বলল রাতুল। ‘চল, এগোই। ঝড়বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া গার্ডগুলাও টহলে বের হবে। তার আগেই বেরিয়ে যাওয়া দরকার।’
‘আরে ধুর, এ তো অন্য চিজ। এতক্ষণে ভয়ে ফিট খেয়ে যাওয়ার কথা। ও তো রিল্যাক্সে দাঁড়ায় আছে। রাতুল, কারে নিয়ে আসলি? কী করবি এখন?’
‘দেখি, লাইট জ্বালা আরও।’ এগিয়ে এসে বলল রাতুল। হাতে এখনো ধরে রেখেছে চোখ। ‘কিরে, এই দেখ, আমার চোখ আমার হাতে। নিবি জিনিসটা?’
‘না। সরো সামনে থেকে।’ ঠেলে ওকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল ইভান।
‘ভয় লাগছে না তো?’
‘ভয় পেয়েছিলাম। এখন আর পাচ্ছি না।’ ঢোঁক গিলে বলল ইভান।
‘তাই নাকি? শাবাশ! তোকেই খুঁজছে বাংলাদেশ।’
‘মানে?’
‘স্কুলে নতুন কেউ এলে আমরা একটু বাজিয়ে দেখি। তোরা তো ভালো স্কুলের ছাত্র। ওইসব স্কুলে আমরা চান্স পাই না। ভর্তি পরীক্ষা, ভাইভা, কতকিছু লাগে ওইসব স্কুলে। আমারে এইসব ভাল্লাগে না।’
‘ও।’
‘ভালো স্কুলের ছাত্রা আমাদের অন্যরকম মনে করে। নাক সিটকায় আমাদের দেখে। তাই না রে?’
‘ঠিক!’ সমস্বরে বলল বাকিরা।
‘এ জন্য এইসব নামকরা স্কুল থেকে আমাদের স্কুলে কেউ এলে আমরা একটা পরীক্ষা নিই। আজকে তোর পরীক্ষা নিলাম।’
‘এটা কোনো সুস্থ পরীক্ষা না।’ রেগে বলল ইভান।
‘কোন পরীক্ষাটা সুস্থ? পরীক্ষা জিনিসটাই অসুস্থ। তোরে যে পরীক্ষায় উদ্দীপক লিখতে হয়, এটা সুস্থ? তুই মেধাবী কিনা, এটা কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে যাচাই করা যায়?’
‘সেটা ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু তোমরা এইভাবে কাউকে হ্যারাস করতে পারো না।’
‘ওরে বাপরে!’ মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করল রাতুল। ‘তোদের বাপের টাকা পয়সা আছে। নামীদামি স্কুলে পড়তি। ঠ্যাকায় না পড়লে তো আমাদের স্কুলে আসতি না। আসতি?’
চুপ করে রইল ইভান। রাতুল আবার বলল,
‘সব স্কুলে তো কম–বেশি একই সুযোগ সুবিধা থাকার কথা। আমি যদি এখন টিসি খেয়ে তোর স্কুলে ভর্তি হতে যাই, নিবে আমাকে?’
বেরোনের উদ্যোগ নিল সবাই। কংক্রিটের বেঞ্চটা থেকে হাত সরাতে গিয়ে ইভান টের পেল, হাতে জ্বালা করছে ওর। আতঙ্কে এত জোরে বেঞ্চটা চেপে ধরেছিল, ছিলে গেছে হাতের তালু। এগোতে গিয়ে দেখল পায়ে শক্তি পাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ চমকাল আবার। ঝোড়ো বাতাসে দুলছে গাছপালা। চিড়িয়াখানা থেকে কোনো একটা প্রাণী চিৎকার করছে অসহায়ের মতো। ইভান বলল,
‘আমি বাসায় যাব। দেরি হয়ে গেছে।’
‘আমরাও যাব বাসায়। তোর পরীক্ষার রেজাল্টটা জানিয়ে দিই। তুই একদম গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিস। ভয় পেলেও কুল ছিলি। ব্যাপারটা ভালো। তোকে আমাদের লাগবে।’
‘মানে?’
‘যারা ভিতু, তারা আমাদের লেভেলের না। তাদের আমরা গুনি না। তুই আমাদের লেভেলের। তোর সঙ্গে আমাদের মিলবে।’
‘এখন পর্যন্ত তোর পারফরম্যান্সই সেরা। রাতুল যখন চোখটা খোলে, তখনই সবাই হিসু করে দেয় ভয়ে। কিন্তু কঠিন নার্ভ তোর। এরকমই আমাদের দরকার।’ পাশ থেকে বলল আরেকজন।
‘হ্যাঁ, এটা ঠিকই বলেছিস।’ চোখটা কোটরে বসাতে বসাতে বলল রাতুল। ‘আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার এই চোখটা আর্টিফিশিয়াল, এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছিস। নতুন কেউ এলে এখানে এনে একটু মজা নিই। তোর হয়তো খারাপ লাগছে। কিন্তু এটা মনে কর আমাদের ট্র্যাডিশন। এখন চল, লাস্ট পর্বটা বাকি আছে।’
‘কী সেটা?’ জিজ্ঞেস করল ইভান।
‘এখন তোর চোখটা তুলে ফেলব।’ বিকট শব্দে হেসে উঠল সবাই।
‘চলো তাহলে।’ বলল ইভান। ‘দ্রুত তুলবা। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, বাসায় যেতে হবে আমাকে।’
‘ওওওও!’ চাপাস্বরে চিৎকার করল সবাই।
‘বলেছিলাম না, ও একটা জিনিস।’ বলল রাতুল। ‘চল, এগোই। ঝড়বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া গার্ডগুলাও টহলে বের হবে। তার আগেই বেরিয়ে যাওয়া দরকার।’
বেরোনের উদ্যোগ নিল সবাই। কংক্রিটের বেঞ্চটা থেকে হাত সরাতে গিয়ে ইভান টের পেল, হাতে জ্বালা করছে ওর। আতঙ্কে এত জোরে বেঞ্চটা চেপে ধরেছিল, ছিলে গেছে হাতের তালু। এগোতে গিয়ে দেখল পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। ঝিঁ ঝিঁ ধরলে পা যেমন হালকা হয়ে থাকে, সেরকম লাগছে ওর। কাউকে বুঝতে না দিয়েই মনের জোরে হাঁটা শুরু করল ওদের সঙ্গে।
ছেলেগুলো ভয়ংকর। ভাবল ইভান। আরেকটু হলেই হয়তো ভয়ে জ্ঞান হারাতো ও। কীভাবে স্থির ছিল নিজেও জানে না।
যে পথ দিয়ে এসেছিল ইভান আর রাতুল, সে পথ দিয়েই বেরিয়ে গেল ওরা। কিছুদূর এগোতেই স্থানীয় একটা জুসের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সবাই। পছন্দমতো জুস অর্ডার দিল ওরা। একটা লেমনেড অর্ডার দিল ইভান। জুস তৈরি হওয়ার ফাঁকে সবার সঙ্গে ইভানকে পরিচয় করিয়ে দিল রাতুল। বড়সড় একটা ধাক্কার পর ধাতস্থ হতে সময় লাগছে ইভানের। রাতুলের দিকে তাকালেই চোখ হাতে নিয়ে হেঁটে আসার দৃশ্যটা ঘুরছল মাথায়। কিন্তু ব্যাপারটা কাউকে বুঝতে দিল না ও। সবার কথা শুনে বুঝল, রাতুল এবং তার বন্ধুরা এখানকার স্থানীয়। যে কাজটা ওরা করেছে, সেটা কোনোভাবেই মানতে পারছে না ইভান। কিন্তু আপাতত এ নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই নেই ওর। ক্লান্ত লাগছে শরীর। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় যেতে চায় ও।
কয়েক চুমুকেই লেমনেড শেষ করে ফেলল ইভান। গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল একবারে। কোল্ড কফি খেতে খেতে নিজেদের সম্পর্কে ইভানকে ধারণা দিল রাতুল। ‘শোন, আমরা সবাই একসঙ্গে চলি। এটাই আমাদের সার্কেল। অনেক কিছুই করি আমরা। সময় হলেই জানবি আস্তে আস্তে।’
‘কী করো?’
‘সেটা এখন বলব না। তোকে ভালো লেগেছে। তুই ফার্মের মুরগি। তেজ আছে তোর। তোকে আমরা আমাদের সঙ্গে চাই। তুই থাকবি কিনা চিন্তা করে দেখ। আমরা কাউকে জোর করি না।’
চুপ করে রইল ইভান।
খাওয়া শেষে সবাই মিলে বিল দিল, ইভানকে দিতে দিল না কেউই। মেইন রোডের দিকে এগিয়ে দিল ওরা ইভানকে। এখন থেকেই রিকশা পাবে ও। রাতুল বলল,
‘ব্যাচ হিসেবে আমরা কিন্তু ইন্টারেস্টিং। আমাদের সবারই কিছু না কিছু নাই। এই যেমন ধর, আমার একটা চোখ নাই।’
‘আমার একটা দাঁত নাই। জালাল স্যার চড় মেরে দাঁত ফেলে দিয়েছিল।’ বলল একজন। হেসে উঠল সবাই।
‘আমার বাঁ হাতের কেনি আঙুল অর্ধেক নাই।’ আঙুল তুলে দেখাল আরেকজন। হাসল সবাই। শিউরে উঠল ইভান।
‘আমার কোনো লজ্জা নাই।’ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল একজন। ‘প্রতি পরীক্ষায় ফেল করি।’
‘তো ইভান, তুই কিছু বল।’ বলল রাতুল।
‘কী বলব…এই মামা, দাঁড়ান।’ একটা রিকশা থামাল ইভান।
‘অবশ্য তোরা দামি স্কুলের পোলাপান। কোনো কিছুর অভাব থাকার নয় তোদের। ভালো অ্যামাউন্টের পকেট মানি পাস বাসা থেকে।’
রিকশা থামতেই উঠে বসল দ্রুত। বাকিরা ওর উত্তরের অপেক্ষায়। ওদের দিকে তাকিয়ে ইভান বলল, ‘আমার মা নেই।’
একদম চুপ হয়ে গেল রাতুলরা। রিকশাওয়ালা ইভানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মামা, যামু?’
‘হ্যাঁ, আগান।’ বলল ইভান। আর কিছু বলার সুযোগ পেল না রাতুলরা। দ্রুত এগোল ব্যাটারিচালিত রিকশা।
বাসায় ফিরে গোসল শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিল ইভান। সন্ধ্যায় বেশ ধকল গেছে। জীবনে কোনো দিন এত ভয় পায়নি ও। ঘুমিয়ে পড়ল শোবার সঙ্গে সঙ্গেই। রাতে ফুফু এসে ডেকে তুললেন ভাত খাওয়ার জন্য। ফুফাও খেতে বসেছেন টেবিলে। ভাত মাখতে মাখতে ফুফা জিজ্ঞেস করলেন,
‘স্কুলটা কেমন লাগল? সব ঠিকঠাক ছিল?’
‘জি ফুফা।’
‘কোনোমতে পরীক্ষাটা দাও। এই স্কুলে পড়াশোনা তেমন হয় না। নিজে নিজেই পড়তে হবে তোমাকে।’
‘জি।’
‘রমিজ স্যার বললেন বাসায় একটা টিচার রেখে দিতে। সব সাবজেক্ট পড়াবে।’
‘লাগবে না ফুফা।’
‘না না, লাগবে।’ ফুফু বললেন। বাসায় একটা গাইডেন্স দরকার। আজকেও বাসায় ঢুকেছে আটটার দিকে।’
‘সেকি!’ অবাক হয়ে বললেন ফুফা।
‘আজকে একটু দেরি হয়ে গেছে ফুফা। নতুন ক্লাসের ছেলেরা আমাকে নিয়ে জুস খেতে গিয়েছিল। না করতে পারিনি।’
‘মাগরিবের পর বাইরে থাকা আমি পছন্দ করি না। এটা তো জানো তুমি। জানো না?’
‘জি, জানি। এরকম আর হবে না।’
‘স্কুলের ড্রেসটা বানাতে দিতে হবে। কাল নিয়ে যাব তোমাকে৷’
‘আচ্ছা।’
খাওয়া শেষে ঘরে চলে গেল ইভান। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আজ আর পড়তে বসা হবে না। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ফোনটা হাতে নিয়ে। স্ক্রল করতে করতেই ওর মনে হলো, রাতুলের কথা। সত্যিই তো, কাছাকাছি এলাকার দুটি স্কুলে এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য কেন হবে?
সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে থেমে থেমে। বজ্রপাতের শব্দে কয়েকবার ঘুম ভেঙেছে ইভানের। বাতাসে জানালার পর্দা বারবার ছুঁয়ে গেছে ওকে। পায়ের কাছ থেকে পাতলা কাঁথা টেনে গায়ে দিয়েছে ইভান। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে ওর।
নাশতা শেষ করে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল ইভান। ফুফুর কাছ থেকে ছাতা চেয়ে নিয়ে বেরোল বাসা থেকে। ‘ছাতা হারালে কিন্তু বাসায় ঢুকতে দেব না!’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন ফুফু। ইভান ততক্ষণে লাফিয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে।
আজও ইভান কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল ক্লাসে ঢুকে। অনেকেই তাকাল ওর দিকে। বাকিরা পাত্তা দিল না। ভেজা ছাতাটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এল ইভান। কাল সন্ধ্যায় যারা বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরীক্ষা নিয়েছে ওর, তাদের সবাই আছে ক্লাসে। আগের দিনের মতোই পেছনের দিকে বসেছে রাতুল। সেদিকে না গিয়ে সামনে থেকে তৃতীয় বেঞ্চে বসল ইভান। স্যার ক্লাসে ঢোকার আগপর্যন্ত তাকাল না আর কারও দিকে। বসে রইল চুপচাপ। বৃষ্টির কারণে ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা কম। ছাত্রদের দাবির মুখে চার ক্লাসের পর ছুটি হয়ে গেল স্কুল। হইহই করে বেরিয়ে গেল সবাই। ভিড় কমার জন্য অপেক্ষা করল ইভান। একটু পর বাইরে এসে টের পেল, বারান্দায় মেলে দেওয়া ছাতাটা নেই। নিয়ে গেছে কেউ।
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চমকে উঠল রুশা। পড়ার টেবিলে মাথা রেখে অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল ও। শব্দ শুনেই বুঝল, বাবা এসেছেন বাসায়। তার মানে, ১২টা বেজে গেছে। বাবা ইদানীং ১২টার আগে বাসায় ফেরেন না।
চিন্তিত হয়ে ছাতা খুঁজতে শুরু করল ইভান। খুব রেগে যাবেন ফুফু। ছাতা কিংবা বাটি হারালে ফুফু এত রেগে যান কেন, বোঝে না ও। টিসি খাওয়ায় ফুফু যতটা কষ্ট পেয়েছেন, ছাতা ছাড়া বাড়ি ফিরলে যে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই ইভানের।
ছাতা পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে নিচে নেমে এল ইভান। বসে পড়ল স্কুলের সিঁড়িতে। প্যান্ট গুটিয়ে মাঠে ফুটবল খেলছে রাতুলরা। ফুটবল খেলা হয় না অনেক দিন। ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার কোনো তুলনা নেই। খেলতে নেমে যেতে ইচ্ছা করছে ইভানের। কিন্তু রাতুলদের সঙ্গে খেলবে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। ও ভাবল, রাতুল একবার ডাকলেই খেলতে নেমে যাবে। রাতুলের সঙ্গে চোখাচোখিও হলো একবার। কিন্তু ডাকলই না ছেলেটা। অবাক হলো ইভান। নিজেকে আর দমাতে না পেরে ছুটে গেল মাঠে। রাতুল জিজ্ঞেস করল, ‘কোন পজিশনে খেলবি?’
‘ফরোয়ার্ড,’ বলে জায়গা করে নিল ইভান। একটু পরই ওর দিকে বল বাড়িয়ে দিল রাতুল।
ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার মজাই আলাদা। বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন এই খেলায়। বারবার কাদায় পিছলে যেতে হয় ছুটতে গিয়ে। বল যায় একদিকে, খেলোয়াড় যায় আরেক দিকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিক গোলপোস্টের সামনে জমা পানিতে আটকে যায় বল। বল গোলবারে ঢোকাতে গিয়ে ইভান নিজেই গোলপোস্টে ঢুকে গেল কয়েকবার। হাসতে হাসতে কাদাপানিতে গড়িয়ে পড়ল সবাই। খেলার মাঠ সম্পর্ক বদলে দেয় খুব দ্রুত। গতকাল যারা ভয় দেখিয়েছিল ইভানকে, তাদের সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফুটবল খেলল আজ। সহজ হয়ে গেল সম্পর্ক। খেলা শেষে স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে পড়া পানিতে শরীর ধুয়ে নিল সবাই। পুরোপুরি না থামলেও অনেকটাই কমে এসেছে বৃষ্টি। বাসার দিকে পা বাড়াল ইভান। পেছন থেকে রাতুক ডেকে বলল, ‘তুই তো ছাতা ফেলে যাচ্ছিস।’
ইভান পেছনে তাকিয়ে দেখল, রাতুলের হাতে ওর ছাতা। ‘আরে, এটা তোর কাছে গেল কী করে? আমি তো বারান্দায় খুঁজে পেলাম না।’
‘বারান্দায় ছাতা রাখলে ওটা আস্ত থাকবে? সেফ জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলাম। দেখলাম, তুই কী করিস।’
‘এটাও পরীক্ষা নাকি? পাস করেছি?’
‘হ্যাঁ, একদম অটোপাস।’
*
দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চমকে উঠল রুশা। পড়ার টেবিলে মাথা রেখে অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল ও। শব্দ শুনেই বুঝল, বাবা এসেছেন বাসায়। তার মানে, ১২টা বেজে গেছে। বাবা ইদানীং ১২টার আগে বাসায় ফেরেন না। এখন কী কী হবে, জানে রুশা। দরজার পাশে একটা টুল আছে। সেখানে বসে জুতা খুলতে খুলতে বাবা জিজ্ঞেস করবেন, ‘রুশা ভাত খেয়েছে?’ খালা বলবেন, ‘জি, স্যার।’
‘ঘুমিয়ে গেছে না জেগে আছে?’
‘জাইগাই আছে মনে হয়। দেইখা আসমু?’
বাবা আস্তে উঠে দাঁড়াবেন। জুতার র্যাকটা খুলে জুতাজোড়া রাখবেন। সশব্দ লাগাবেন র্যাকের দরজা। তারপর বলবেন, ‘খাবার দাও টেবিলে।’ তারপর এগোবেন রুশার ঘরের দিকে। পুরো ব্যাপারটা মুখস্থ হয়ে গেছে রুশার। বাবা ঘরের কাছে আসতেই কোল থেকে নিঃশব্দে নেমে গেল বিড়ালটা। ‘তোর আবার কী হলো?’ অবাক হয়ে বলল রুশা।
দুবার টোকা দিয়েই দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিলেন রুশার বাবা। ‘কী অবস্থা মা, সব ঠিকঠাক?’
‘হু।’ বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলল রুশা।
‘কোচিংয়ে গিয়েছিলে?’
‘হুঁ।’
‘মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘হুঁ।’
‘তাকাও আমার দিকে, একবারও তো তাকাচ্ছ না।’
‘তাকালাম,’ বলে বাবার দিকে তাকাল রুশা। ওর মনে হলো, বাবার মুখে ক্লান্তির ছাপ। নাকি দুশ্চিন্তা? শরীর খারাপ কি না, জিজ্ঞেস করবে?
‘তুমি এ মাসেও ডাক্তারের কাছে যাওনি। কেন?’
‘ভালো লাগে না বাবা। আর আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি ঠিক আছি।’
‘মা ফোন করেনি?’
‘করেছে। তখন ফোনের কাছে ছিলাম না।’
‘কাল মাকে ফোন করবে, ওকে?’
‘হুঁ।’
‘টাকাপয়সা কিছু লাগবে?’
‘না, লাগলে বলব।’
‘আমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না?’
‘এখন লাগছে না।’
‘ওকে। গুড নাইট। শুয়ে পড়ো। বেশি রাত কোরো না।’ বলে বাবা দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলেন।
‘তোমার সাথে কথা বলতে খুব লাগে, বাবা। কাজের কথা না, অর্থহীন কথা। আজ বৃষ্টিতে একজনের ছাতা উড়ে গেল, সেই কথা। বৃষ্টির পর হালকা করে রামধনু দেখেছিলাম সেই কথা। তোমার তো সময়ই নাই, বাবা।’ ফিসফিস করে বলল রুশা। হালকা করে একটা হাত এসে পড়ল রুশার কাঁধে। ছলছল চোখে রুশা দেখল, ওর কাঁধে হাত রেখেছে বিড়ালটা। আসলে রেখেছে সামনের পা-টা, কিন্তু ওটাকে হাত বলাই ভালো। রুশা অবাক হয়ে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘মন খারাপ কোরো না।’ স্পষ্ট কিন্তু নরম গলায় বলল বিড়ালটা। রুশার চোখে বিস্ময়। বিড়ালটা ওর কাঁধে উঠে বলল, ‘তোমার বাবা খুব চাপে আছে।’ হাঁ হয়ে গেল রুশার মুখ। ‘খুনি কে, তা বের করতে না পারলে চাপ আরও বাড়বে।’
বিড়ালটার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইল রুশা। এ ছাড়া আর কী করার আছে ওর?
চলবে...
আদনান মুকিতের লেখা 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যা থেকে কিশোর আলোতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০২৫ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রথমা প্রকাশনী থেকে কিশোর উপন্যাসটি পরিমার্জিত হয়ে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি কিনতে পাওয়া যাবে এই লিংক থেকে: 'দ্য নিউ অ্যাডভেঞ্চার অব ফার্মের মুরগি' । লিংকে ক্লিক করে বইটি অর্ডার করতে পারো অথবা ফোন করো এই নম্বরে: 01730000619